দৃষ্টি সংযত রাখার ১০টি কৌশল

দৃষ্টি সংযত রাখতে পারেন না?

বেহায়াপনার এই যুগে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো দৃষ্টি সংযত রাখা। রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে ঘরের চার দেয়ালেও মুক্তি নেই। চোখের পলকেই নিজেকে ধ্বংসের অতলে ডুবিয়ে দেবার সকল আয়োজন করে রাখা হয়েছে। ফলে মুমিন শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চোখের ওপর লাগাম পরাতে পারে না। বার বার ব্যর্থ হয়। হারাম সম্পর্ক, পর্ন আসক্তি, ধর্ষণ সবকিছুর মূলে থাকে দৃষ্টির লাগামহীন ছোটাছুটি। অন্তরের পবিত্রতাকে নষ্ট করে ফেলে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ফিতনার এই যুগে কীভাবে আমরা দৃষ্টি অবনত রাখতে পারি? কীভাবে এই অভ্যাস গড়তে পারি?

(১) দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা এবং আল্লাহর সাহায্য চাওয়া

যে কোনো গুনাহ থেকে বাঁচতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জরুরী। মন যদি গুনাহের দিকে ধাবমান থাকে, আর মুখে যদি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার কথা বলি, তাহলে দিনশেষে ফলাফল অপরিবর্তিতই থাকবে। তাই শুরুতেই আপনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রয়োজন, পাশাপাশি আল্লাহর কাছে প্রচুর দুআ করতে হবে। নিজের ইচ্ছার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করাও মুমিনের কাজ না। এক্ষেত্রে আপনি ইউসুফ (আ.)-এর দুআটি দেখতে পারেন। তিনি নবী হওয়া সত্ত্বেও দুআ করেছিলেন: ‘(হে আল্লাহ্‌) আপনি যদি তাদের (অর্থাৎ নারীদের) চক্রান্ত আমার ওপর থেকে প্রতিহত না করেন, তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ (সূরা ইউসুফ, ১২: ৩৪)

(২) আল্লাহকে ভয় করা, লজ্জা করা

বান্দা যখন এই কথা মনে রাখবে, আল্লাহ্‌ তার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছে, তিনি চোখের খেয়ানত, মনের লুকোচুরি—সবই জানেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই বান্দা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের অপব্যবহার এবং তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত হওয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাকওয়া, লজ্জা ও পরকাল বিষয়ক বিভিন্ন বই আপনার পাঠ্য তালিকায় সবসময় রাখতে পারেন। যেমন: লজ্জা: ঈমানের একটি শাখা, তাকওয়া: মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন, জীবনের ওপারে

(৩) পুরষ্কার ও শাস্তির কথা মনে রাখা

দুনিয়ার যে কোনো কাজের লাভ-ক্ষতি জানা থাকলে সে কাজ করা বা না করা দুটোই সহজ হয়। কাজটা আর কষ্টসাধ্য মনে হয় না। দৃষ্টি সংযত রাখার অনেক উপকারিতা রয়েছে। এর কিছু দিক আমাদের মুমিনদের বলো, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে ব্লগে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে এই বইগুলো পড়তে পারেন: দৃষ্টি শয়তানের বিষাক্ত তীর, নজরের হেফাজত : সফলতার হাতিয়ার

(৪) বিয়ে করা নয়ত লাগাতার রোজা রাখা

এ ব্যাপারে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে ফেলে। কেননা চোখ ও যৌনাঙ্গ সংযত রাখার ক্ষেত্রে বিয়ে অধিক কার্যকরী। আর যে (বিয়ের) সক্ষমতা রাখে না, সে যেন রোজা রাখে। কেননা, রোজা যৌন উত্তেজনা দমিয়ে রাখে।’ (সহীহ বুখারী, ৫০৬৬)

(৫) মোবাইল সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা

বর্তমানে চোখের গুনাহ করতে আর বাহিরে যেতে হয় না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই বিশ্বের যে কোনো দেশে ছুটে চলা যায়। দেখা যায় নীল জগতের সব নোংরা দৃশ্য। শুধু তা-ই নয়, নাটক-সিনেমার বিশাল জগত রয়েছে এতে। তাই যে চায় নিজের চোখের হেফাজত করতে, তাকে সবার আগে ইন্টারনেটের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। অহেতুক ব্রাউজিং, মুভি দেখা, বিনোদনের জন্য ভিডিও ক্লিপ দেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় পর নারীদের সাথে যোগাযোগ করা, এসব থেকে দূরে থাকতে হবে।

(৬) খারাপ বন্ধুদের সাথে না চলা

আমাদের অনেক গুনাহের পেছনে মূল প্রেরণা যোগায় অসৎ বন্ধুরা। যেমন, আজকাল যেন ‘মেয়ে’ বিষয়ক আলোচনা ছাড়া আড্ডাই জমে না। তাই এমন সব অসৎ সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে হবে, যারা আপনাকে গুনাহের পথে ওয়াসওয়াসা দেয়। মানুষ হিসেবে তারা যতই ভালো হোক, তারা আপনার পরকালের জন্য ভালো নয়।

(৭) নারীদের স্থানগুলো এড়িয়ে চলা

চোখের গুনাহ থেকে বাঁচার একটি সহজ উপায় হচ্ছে, নারীদের স্থানগুলো এড়িয়ে চলা। বিশেষ করে যেসব স্থানে নারীদের আনাগোনা বেশি। যেমন, মার্কেট, কলেজ ভার্সিটি, রেস্টুরেন্ট। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এসব এড়িয়ে চলা উচিত এবং বিকল্প খুঁজে বের করাই নিরাপদ।

(৮) ফিতনার যুগে ঘরকে আপন করে নেওয়া

হাদীসে এসেছে, একবার উকবা ইবনু আমি (রাদ্বি.) নবীজি (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন, ‘আল্লাহর রাসূল, কোন জিনিসে মুক্তি?’ নবীজি উত্তর দিলেন, ‘তোমার জিহ্বার ওপর নিয়ন্ত্রণ নাও। তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয় (অর্থাৎ ঘরেই অবস্থান করো)। আর নিজের গুনাহের ওপর কান্না করো।’ (আহমাদ, ৫/২৫৯; তিরমিযি, ২৪০৬)। আরেক হাদীসে তিনি বলেন, ‘সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য, যে নিজের জিহ্বাকে সংযত রাখে। তার ঘর তার জন্য প্রশস্ত(অর্থাৎ ঘরেই অবস্থান করে)। আর সে নিজের পাপের ওপর ক্রন্দন করে।’ (আবূ দাউদ, আয-যুহদ, ৩৭২)

আর সবচেয়ে বড় কথা, যে আল্লাহর জন্য নির্জনতা অবলম্বন করে, সে কখনও একা হয় না। সে আল্লাহর সাথেই থাকে। আল্লাহকে নিয়েই তার সময় কাটে। মালিক ইবনু মিগওয়াল (রহ.) বলেন, ‘যে আল্লাহর জন্য নির্জনতা অবলম্বন করে, আমি তো তাকে নিঃসঙ্গ মনে করি না।’

ফিতনার দিনে নির্জনতার আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: ফিতনার দিনে নির্জনবাস বইটি।

(৯) নিজেকে জরিমানা করা

প্রতিবার চোখের গুনাহ হলে নিজেকে জরিমানা করুন। এটা হতে পারে দান সদকা করা, গরীবদের খাওয়ানো, রোজা রাখা ইত্যাদি। আপনি আপনার দুর্বলতা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনার যদি আর্থিক সমস্যা থাকে, তাহলে জরিমানা হিসেবে দান সদকা বা গরীবদের খাওয়ানো-কে বেঁছে নিন। আপনি ধনী হলে অর্থের পরিমাণ বেশি করুন। একসময় মন চোখের গুনাহ ছেড়ে দেবে। আর আপনার যদি অর্থ-বিত্তে কোনো লোভ না থাকে, তাহলে রোজার পদ্ধতি খাটাতে পারেন। না খেয়ে থাকার কষ্টে মন সোজা থাকবে। এভাবে নিজের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।

(১০) তাওবা ইস্তিগফার চালু রাখা

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা যত পদক্ষেপই নিই, আমাদের দ্বারা ভুল হয়ে যায়। হাদীসে এসেছে, ‘বনী আদম মাত্রই প্রত্যেকে ভুলকারী। তবে ভুলকারীদের মধ্যে তারাই সেরা, যারা বার বার তাওবা করে।’ (আহমাদ ১৩০৪৯, তিরমিযী ২৪৯৯)

প্রতিবার চোখের গুনাহ হয়ে গেলে ইস্তিগফার করুন। ঘুমাতে যাবার আগে এজন্য আল্লাহর কাছে কাঁদুন। আল্লাহ্‌ দয়া করলে মানুষ পারে না এমন কিছু নেই।

ইউসুফ (আ.)-এর গল্পটা স্মরণে আছে নিশ্চয়ই। জুলেখা যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল, তখন সে বলেছিল: ‘আর আমি আমার নফসকে পবিত্র মনে করি না, নিশ্চয় নফস মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা ইউসুফ, ১২: ৫৩)

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ রহম করলে বদকার নফসও নেককার হয়ে যায়। কাজেই ইস্তিগফার করুন, আল্লাহর কাছে তাঁর দয়া ভিক্ষা চান।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কথাগুলোর ওপর আমল করার তাওফীক দিক।

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *