ডেঙ্গু রোগ ও প্রতিকার

বাড়ছে ডেঙ্গু আতঙ্ক, আপনি সচেতন হচ্ছেন তো?

আশঙ্কাজনক হারে দেশে বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরের আক্রমণ। প্রতিনিয়তই অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ পর্যন্ত মারাও গেছেন অনেকে। এটুকু শুনে অনেকেই হয়তো বুঝতে পারছেন না সমস্যার গভীরতাটা ঠিক কতোটুকু। যারা সমস্যাটির গভীরতা বুঝে উঠতে পারছেন না, তাদের জন্য বলি যে এবারের ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্যবারের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। টেস্ট করেও ঠিকঠাক মতো ধরা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর উপস্থিতি। জ্বর হলে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না জ্বরটা কি ডেঙ্গুজ্বর নাকি সাধারণ কোনো জ্বর। আপনারা কি বুঝতে পারছেন এবারের ডেঙ্গুর ভয়াবহতা?

সময় এখন সচেতন হবার। নিজেকে সচেতন হতে হবে, সাথে অন্যদেরও সচেতন করতে হবে। জেনে নিতে হবে কী কী লক্ষণ দেখে ডেঙ্গু চেনা যায়। কীভাবে এই রোগ থেকে বেঁচে থাকা যায় এবং কেউ আক্রান্ত হলে কীভাবে রোগীর যত্ন নেওয়া যায়। চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

ডেঙ্গু : কারণ ও লক্ষণ

ডেঙ্গুর কারণ হচ্ছে এডিস মশার কামড়। এই মশার কামড় থেকেই ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়ায়। ডেঙ্গুর কারণটা অপরিবর্তিত থাকলে এবার ডেঙ্গুর লক্ষণের প্যাটার্নে এসেছে অনেক পরিবর্তন। স্বাভাবিকভাবে ডেঙ্গু হলে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, সেগুলোর সব এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও আমরা প্রথমে এই ক্লাসিক্যাল সিম্পটমগুলো আপনাদের জন্য তুলে ধরছি –

১। তীব্র জ্বর।
২। প্রচণ্ড মাথাব্যথা।
৩। চোখের পেছনে ব্যথা।
৪। শরীরের পেশী ও হাড়ের গিটে গিটে ব্যথা।
৫। মাথা ঘোরা।
৬। বমি বমি ভাব।
৭। র‍্যাশ বা ত্বকে লাল ছোপ ছোপ দাগ থাকা।
৮। নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া।
৯। রক্তে প্লাটিলেট কমে যেতে থাকা।
১০। গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।

এগুলো ডেঙ্গুর কমন কিছু সিম্পটম। কিন্তু আমরা পাঠককে সতর্ক করে দিচ্ছি যে, এগুলোই কিন্তু শেষ কথা নয়। যেমনটা আমরা আগেই বলেছি যে, এবারের ডেঙ্গুর প্যাটার্ন বদলে গেছে। সর্দিকাশি থাকলে আগে ডাক্তাররা ডেঙ্গুর রোগী হিসেবে শনাক্ত না করলেও এখন আর সেভাবে উনারা ভাবছেন না। কারণ, সর্দিকাশি আছে এমন অনেকের ক্ষেত্রেও ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। তাই জ্বর না হলেই যে আপনার ডেঙ্গু হয়নি, এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এছাড়াও, জ্বর হলেই ধরে নেবেন যে ডেঙ্গু। এটা ভেবে বসে থাকবেন না যে, এটা তো অন্য জ্বরও হতে পারে। জ্বর ধরা পড়বার পর মোটেই অপেক্ষা করবেন না, সাথে সাথে টেস্ট করিয়ে নিন।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এমনকি টেস্টের পরও আপনার ডেঙ্গু ধরা নাও পড়তে পারে। টেস্ট নেগেটিভ এসেছে, এমন কেইসের ক্ষেত্রেও পরে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। তাই কখনোই নিশ্চিত হয়ে যাবেন না, বরং সার্বক্ষণিক সতর্কতা বজায় রাখুন।

উপরে দেওয়া তালিকাতে আমরা র‍্যাশ হবার কথা বলেছি, এখন কিন্তু এটা আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। এই জ্বরে প্রচণ্ড মাত্রায় শরীর ব্যথা হয়, এ বছর সেই প্যাটার্নেও পরিবর্তন এসেছে। তাই উপরের লক্ষণগুলোর উপর ভরসা করে মোটেই বসে থাকবেন না। সর্দিকাশি কিংবা জ্বর, যেটাই হোক না কেন সাথে সাথে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন ও সতর্কতা অবলম্বন করুন। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন। তাদের অবস্থা খুব দ্রুতই খারাপ হয়ে যায় এবং এরকম বেশ কিছু ঘটনা এবার ধরা পড়েছে যেখানে মায়ের ডেঙ্গু হবার কারণে বাচ্চা পেটেই মারা গেছে। তার উপর এবার রোগী খুব দ্রুতই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে চলে যাচ্ছেন, রীতিমতো ২-১ দিনের ভেতরেই। তাই খুব সাবধান!

আক্রান্ত হলে করণীয় কী?

১। আক্রান্ত হলে করণীয় জানার আগে বুঝতে হবে আপনি আক্রান্ত কি না। সেজন্য প্রথমেই আপনাকে হাসপাতালে গিয়ে তিনটা টেস্ট করে ফেলতে হবে –

১। CBC
২। Dengue NS1
৩। SGOT
Dengue NS1 পজিটিভ আসলে বুঝে নেবেন আপনার ডেঙ্গু হয়েছে। প্রথম প্রথম রিপোর্ট নরমাল আসতে পারে, তবে আপনাকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। কারণ প্রথম রিপোর্ট এমনটা আসতেই পারে। CBC টেস্টের রিপোর্ট থেকে আপনার হেমাটোক্রিট লেভেল জেনে রাখবেন এবং সংরক্ষণ করবেন। এটা পরে দরকার পড়বে। তৃতীয় টেস্ট অর্থাৎ, SGOT এর রিপোর্টে যদি সাধারণ মাত্রার চাইতে ৪-৫ গুণ বেশি ধরা পড়ে, তবে আপনার জন্য বিপদসংকেত! সামনে রোগীর অবস্থা অনেক খারাপের দিকে যেতে পারে। তাই সাবধান!

২। প্রথম থেকেই ডাক্তার দেখাবেন এবং ব্যথার জন্য কখনোই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কিছু খাবেন না। একেবারেই না!

৩। প্রতিদিন আপনাকে অবশ্যই CBC টেস্ট করাতেই হবে। রোগের অবস্থা কোন পর্যায়ে, সেটা বুঝতে এটা আবশ্যক। যদি প্রথম দিনের তুলনায় হিমোগ্লোবিন ও হেমাটোক্রিট দুটোই অনেক কমে যায়, তবে বুঝবেন বিপদ আসন্ন।

৪। খুব ভালোভাবে মাথায় রাখুন যে, ভয়টা জ্বর অবস্থায় কিন্তু নয়, জ্বর নেমে যাবার পরে। আসল বিপদটা শুরু হয় জ্বর নেমে যাবার পর থেকেই। ওটাই হচ্ছে ক্রিটিক্যাল ফেইজ এবং তখনই অনেক রোগী শকে চলে যান। এই শক থেকেই অনেক রোগী এবার মারা যাচ্ছেন। তাই জ্বর কমে গেলে কখনোই গা ছেড়ে দেবেন না, বরং আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠুন।

৫। দিনে তিনবারের বেশি বমি বা পাতলা পায়খানা হলে সোজা হাসপাতালে চলে যান। মোটেও গড়িমসি করবেন না।

৬। বাসায় থাকাকালীন রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ান। দৈনিক ২-৩ লিটার পানি, ডাবের পানি, স্যালাইন, লবণ-চিনির শরবত ইত্যাদি তরল খাবার খাওয়াতে থাকুন।

৭। বাচ্চা এবং গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন। আর অবশ্যই কোনো প্রকার লক্ষণ ধরা পড়লে ‘কয়েকদিন দেখি’ – এ ধরনের কোনো চিন্তাভাবনা একদমই করতে যাবেন না।

৮। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের বুদ্ধিতে বা ফার্মেসির পরামর্শে কোনো ধরনের ঔষধ খেতে যাবেন না।

বাঁচার উপায় কী?

অবশ্যই সবার আগে আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, ডেঙ্গু পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া সবচেয়ে অ্যালার্মিং বিষয় হলো, এডিস মশা এখন আর কেবল দিনেই কামড়াচ্ছে না এবং এক ধরনের পানিতেই কেবল তারা জন্মাচ্ছে না। এডিস মশা এখন দিনেরাতে যেকোনো সময়ই আপনাকে কামড়াতে পারে এবং পরিষ্কার বা নোংরা যেকোনো ধরনের পানিতেই এরা জন্ম নিচ্ছে। তাই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হন এবং সেই অনুযায়ী সতর্কতা অবলম্বন করুন।

১। বাসাবাড়িতে কোথাও পানি যেন না জমে, সেজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করুন।
২। সাদা দাগওয়ালা মশার কামড় থেকে সাবধান থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন।
৩। নিজের ঘর এবং আঙিনা পরিষ্কার রাখুন।
৪। জ্বর বা নতুন করে সর্দিকাশি দেখা দিলে অপেক্ষা না করে সাথে সাথে প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো করিয়ে নিন এবং রিপোর্ট নরমাল আসলেও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
৫। ব্লাড প্রেশার নিয়মিত মেপে দেখুন।
৬। তরল খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন।
৭। সর্বোপরি মহান আল্লাহর উপর ভরসা করুন এবং তাঁর কাছে নিরাপত্তা কামনা করুন।

মনে রাখবেন, ডেঙ্গুর কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তার উপর এবার জ্বর তার চিরচেনা প্যাটার্ন পরিবর্তন করায় অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোতে প্রচুর রোগী। তাই নিজের যত্ন নিন, পরিবারকেও সচেতন করে তুলুন। তাদেরকে সতর্ক করুন এই বিপদ সম্পর্কে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের খবর নিন, খেয়াল রাখুন একে অন্যের। আর সব ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে থাকতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে বেশি বেশি দু’আ ও ইস্তিগফার করুন।

আল্লাহ আমাদের এই মুসিবত থেকে উদ্ধার করুন। যারা অসুস্থ হয়েছেন তাদেরকে সুস্থতার নিয়ামত ফিরিয়ে দিন। আর যারা ইন্তিকাল করেছেন তাদেরকে মাফ করে দিন। আমীন।

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *