ছোটদের দ্বীন শিক্ষা

বলা হয়ে থাকে, শিশুদের অন্তর হচ্ছে কাদামাটির মতো। তাতে যেটাই লিখে দেওয়া হবে, সেটাই সময়ের আবর্তনে শক্ত হয়ে অন্তরের মধ্যে বসে যাবে। কথাটা শতভাগ সত্য। শিশুদের মনের বাগানে যদি আমরা ফোটাতে চাই ঈমানের ফুল, যদি আমরা চাই বড় হয়ে তারা হোক আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা তবে সেটার সূচনা করতে হবে অতি অবশ্যই জীবনের প্রথম বেলাতেই। জীবনের সুবহে সাদিকে যদি তাদেরকে আমরা দ্বীনের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারি, তবে বাকি জীবন তারা দ্বীনের উপর থাকবে বা দ্বীনকে আপন করে নেবে এমন আশা করাটা আসলে ভিত্তিহীন হয়ে যায়।

যদি কেউ পরিণত বয়সে গিয়ে আল্লাহর অনুগত হয়ে ওঠে, তবে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এতে করে শিশু বয়স থেকে দ্বীনের শিক্ষা পাওয়ার বিষয়টির গুরুত্ব কোনো অংশেই কমে যায় না। অতএব আমরা কোনোমতেই এটা বলতে পারবো না যে, বড় হলে এমনিতেই সে দ্বীন শিখে নেবে বা এমনিতেই দ্বীনের উপর চলতে শুরু করবে।

না। কোনোকিছুই এমনি এমনি হয়ে যায় না। কোনোকিছু হওয়ানোর জন্য সেটার পেছনে খাটতে হয়, শ্রম দিতে হয়। মনের মতো করে কিছু পাওয়ার জন্য সেটার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হয়। একটা শিশু একটা চারাগাছের মতোই। যেনতেনভাবে একটা চারা রোপণ করলেই যেভাবে ভালো একটা গাছের আশা করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের দ্বীনের শিক্ষা না দিয়ে বসে বসে শুধু আশা করলেও তারা বড় হয়ে দ্বীনদার হয়ে উঠবে না। দ্বীনদার হওয়ার জন্য ছোট থেকেই তাদের দ্বীনের শিক্ষা দিয়ে বড় করতে হবে, ঠিক যেভাবে দুনিয়া শেখানোর জন্য ছোট থেকেই আমরা তাদের দুনিয়াবি শিক্ষা দিতে থাকি।

তাছাড়া ছোট বয়সে যেকোনো কিছুই শেখাটা অনেক সহজ। এ সময় মনটা থাকে খালি, শেখার আগ্রহ আর জায়গা থাকে একদম ফ্রেশ। যেমনটা আমরা শুরুতেই বলে এসেছি যে, শিশুমন হচ্ছে একতাল কাদামাটির মতো। একে যেভাবে গড়ে নেওয়া হবে, সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। তাই দ্বীনের ছাঁচে যদি শিশুমনকে গড়ে তোলা হয়, তবে আশা করা যায় বড় হয়েও সে আল্লাহর রহমতে দ্বীনের উপরই বহাল থাকবে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দ্বীনের উপরই অটল-অবিচল থাকবে।

ছোটদের দ্বীন শিক্ষার বিষয়ে আমাদের গাফিলতির পেছনে অবশ্য একটা বড়সড় কারণ আছে আর তা হলো দ্বীন বলতে কী বোঝায় সেটা সম্পর্কেই আমরা অজ্ঞ। আমরা মনে করি কায়দা, সিফারা, আমপারা হয়ে কুরআন পড়া, কিছু দু’আ শেখা আর নামায শেখা—এই হচ্ছে দ্বীন। দ্বীনকে আমরা প্রায়শই ধর্মকর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলি। আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম বলতে যা বোঝায়, দ্বীন বলতে তা বোঝায় না। দ্বীন হচ্ছে অনেক ব্যাপক একটা শব্দ, যার মধ্যে ধর্ম আছে। আমরা শিশুদের দ্বীন শিক্ষা দেবো, ধর্ম নয়। আমরা অবশ্যই তাদের কালিমা, নামায, কুরআন শেখাবো। কিন্তু এগুলোকে জীবন বিচ্ছিন্ন স্রেফ “ধর্মকর্ম” হিসেবে শেখানোর নিয়ত নিয়ে শেখাবো না। এগুলোর মধ্য দিয়ে শিশুরা তাদের দ্বীনকে চিনে নেবে। তারা আল্লাহকে চিনবে, আল্লাহর রাসূলকে জানবে, সাহাবীদের জানবে। তারা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ-নিষেধ জানবে ও মানবে। এভাবেই তাদেরকে দ্বীনের ছাঁচে গড়ে তোলা হবে। এটাই হচ্ছে দ্বীন শিক্ষা।

তো যাইহোক, দ্বীন শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভ্রান্ত ধারণা ও বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে শুরুতেই কিছু কথা আমরা বলে ফেললাম। এবার বিষয়টির সামগ্রিক একটা রূপ নিয়ে দু’চারটা কথা বলা যাক। কীরকম হবে শিশুদের দ্বীন শিক্ষার রূপ? এখানে সহজ একটি নীতি হচ্ছে, শিক্ষাপ্রদান করা হবে প্রয়োজন ও গ্রহণ করার ক্ষমতা—এই দুটো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। একটা হচ্ছে সেই পরিমাণ ইলম, যা শিশু বয়সেই শিখে ফেলা প্রত্যেক শিশুর জন্য জরুরি। আর অন্যটি হচ্ছে এর চেয়ে অগ্রসর হয়ে আরো কিছু বিষয় শেখা, যা নির্ভর করবে প্রতিটি শিশুর নিতে পারার ক্ষমতার উপর। কালিমা, নামায, কুরআন, মাসনূন দু’আ, আদব-আখলাক—এসবের পাঠ তো প্রতিটি শিশুর জন্যই আবশ্যক। বাকি এর চেয়েও বেশি কিছু শেখানোর বিষয়টি নির্ভর করবে শিশুর বুদ্ধিমত্তা ও আগ্রহের উপর। তবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের অবশ্যই এই বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বয়স অনুযায়ী যে বিষয়গুলো যখন শেখানো আবশ্যক সেগুলোর পাঠ যথাযথভাবে তারা দিতে পারছেন কি না। এটা নিশ্চিত করতে পারলেই শিশুদের দ্বীন শিক্ষার বিষয়টিকে সফল হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

শেষ যে কথাটি আমরা বলতে চাই তা হলো, দ্বীন প্রথমে শেখা ও পরে চর্চা করার বিষয়। শিশু দ্বীন তো অবশ্যই শিখবে, কিন্তু এর চর্চা করার আগ্রহ ও উদ্দীপনা সে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকেই গ্রহণ করবে। বাবা-মা যদি দ্বীনের চর্চায় আগ্রহী না হন, সন্তানকে দ্বীন শিক্ষায় লাগিয়ে দিয়ে তারা নিজেরাই যদি অজ্ঞতার আঁধারে হাবুডুবু খেতে থাকেন বা দ্বীনের চর্চায় গাফিলতি প্রদর্শন করেন, তবে হতে পারে সন্তানও তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। সেক্ষেত্রে তার দ্বীনের জ্ঞান অর্জন কোনো কল্যাণকর ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারবে না। তাই সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের আন্তরিকতা খুবই জরুরি। তাদের কাজ শুধু সন্তানকে দ্বীনের শিক্ষা দেওয়া নয়, বরং নিজেরাও দ্বীনের প্রতি আন্তরিক থাকা ও সন্তানকে দ্বীন পালনে আগ্রহী করে তোলা। তবেই তো কেবল দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার এই আয়োজন সফল বলে বিবেচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আমাদের সন্তানদেরকে তাঁর অমূল্য দ্বীনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে দিন। তাদের অন্তরে তাঁর, তাঁর রাসূল ও তাঁর দ্বীনের জন্য ভালোবাসার বীজ বুনে দিন। তাদেরকে ঈমানের একেকজন মহীরুহ বানিয়ে দিন। তাদের থেকেই তুলে আনুন সাহাবায়ে কেরামের মতো সোনার টুকরো একেকটা মানুষ। আল্লাহুম্মা আমীন।

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *