মুমিনদের বলো, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে

বনী আদমের ওপর আল্লাহর অকৃত্রিম নিয়ামতরাজির একটি হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। না চাইতে পাওয়া এই দৃষ্টিশক্তি যে কত বড় নেয়ামত—এ কেবল একজন অন্ধ ব্যক্তিই বোঝে। এর মূল্য এবং যথোপযুক্ত ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কবরের মানুষগুলো হারে হারে টের পাচ্ছে। তাই আমরাও চাই দৃষ্টি অবনত রাখতে, আমরা চাই এই দৃষ্টি কোনো হারাম বস্তুর দিকে না পড়ুক। দৃষ্টির উদ্ভ্রান্ত ছোটাছুটি এবং লাগামহীন বিচরণ ইতিমধ্যে আমাদের বহু ক্ষতি ডেকে এনেছে। এই ক্ষতি আর বাড়তে দেয়া যাবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, ফিতনার এই যুগে কীভাবে আমরা দৃষ্টি অবনত রাখতে পারি? কীভাবে এই অভ্যাস গড়তে পারি?

(১) হালাল বিষয়ে ব্যস্ত থাকা

দৃষ্টি মনের দরজা। ইবলিশের সবচেয়ে প্রশস্ত পথ। সে বনী আদমকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি দৃষ্টির দ্বারাই করে। আপনি দৃষ্টিকে যে দিকে নিবদ্ধ রাখবেন, মন সে কাজেই ব্যস্ত থাকবে। তাই দৃষ্টিকে হালাল বিষয়ে ব্যস্ত রাখুন। উপকারী কাজে একে ক্লান্ত করে তুলুন। এটাই এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। অবসর সময়ে কুরআন পড়ুন, উপকারী বই পড়ুন, লিখুন। যতক্ষণ মোবাইল হাতে থাকছে, চেষ্টা করুন প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যবহার করতে। সত্যি বলতে আমাদের অধিকাংশের দৃষ্টি লাগামহীন হবার পেছনে আমাদের অভ্যাসগুলো দায়ী। বার বার পর নারীদের দিকে দৃষ্টিপাত, মুভি-সিরিয়াল দেখার এই অভ্যাসই আমাদের সংকল্পকে কঠিন করে তুলেছে। 

(২) অবস্থা পরিবর্তন

কুদৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে এমন প্রত্যেক স্থান পরিত্যাগ করুন। এমন স্থানে যাবেন না যেখানে গেলে কুদৃষ্টির ফাঁদে পড়বেন নিশ্চিত। তাহলে কি সর্বক্ষণ ঘরে বসে থাকতে হবে? না, আমরা এমনটাও বলছি না। আমরা নিজেদের সাথে সৎ হবার কথা বলছি। আমরা প্রত্যেকেই ভালো করে জানি, কোথায় গেলে এবং কোথায় বসলে আমাদের দৃষ্টি লাগামহীন হয়ে পড়ে। তাই নিজেদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চাইলে আজ থেকেই স্থান পরিবর্তনে সচেতন হোন। খেয়াল রাখুন কোথায় বসছেন এবং কাদের সাথে বসছেন।

(৩) বেশি বেশি সিয়াম পালন

নবীজি (ﷺ) বলেন, ‘হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে। আর যাদের বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন সাওম পালন করে; কেননা, সাওম তার যৌনতাকে দমন করবে।’ [সহীহ বুখারী (৫০৬৬)]

সাওম আমাদের চৈতন্য জাগ্রত রাখে। আমাদের ভিতর এই বিবেকবোধ তাজা রাখে, আমি সাওম পালন করছি। দ্বিতীয়ত পেট ক্ষুধার্ত থাকায় আমাদের যৌনাকাঙ্ক্ষাও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে এই সময়। তাই বেশি বেশি নফল সাওম রাখুন।

(৪) আল্লাহর প্রতি সচেতনতা

মানুষ যত বড় দুর্নীতিবাজই হোক, সিসি ক্যামেরা দেখলে নড়েচড়ে বসে। অথচ এই সিসি ক্যামেরা মানব সৃষ্টি যন্ত্র। আর মানুষের শাস্তিও সীমিত পর্যায়। এই দিকে ক্ষমতাসীনরা এর পরোয়া করে না। কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারবে না। তাঁর দৃষ্টি এক নিমেষের জন্যও গাফেল হয় না। আমাদের সামনে পেছনে ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন তিনি। কিরামান কাতিবীন, তাদের কাছে আমাদের ছোট বড় কোনো কাজই গোপন নয়। তারা পালাবদল করে আসে, প্রতিদিন এবং প্রতিটি মুহূর্ত তারা রেকর্ড করে নিয়ে যায়। তাই যে কোনো অপরাধ রোধে এই সচেতনতা তৈরি হওয়া জরুরী ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’। দুনিয়ার সবার থেকে নিস্তার পেলেও তাঁর হাত থেকে মুক্তি নেই। আর এই সচেতনতাকেই বলে তাকওয়া। আমাদের সালাফগণ বলতেন, ‘বেশি বেশি আমল করার নাম তাকওয়া নয়, বরং আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নামই তাকওয়া।’ কাজেই তাকওয়ার শিক্ষা দেয়, তাকওয়াকে মজবুত করে, এমন কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন। মুত্তাকীদের সাথে সময় দিন।

(৫) মৃত্যুর স্মরণ

যে কোনো মন্দ কাজ পরিত্যাগের ক্ষেত্রে তার পরিণতির স্মরণ আমাদের মানব মনে বেশ ভালো প্রভাব ফেলে। বাস্তবতার জ্ঞান আমাদের উদ্বুদ্ধ করে মন্দ কাজটি ছাড়তে। মনের ওপর লাগাম পরায়। মৃত্যু মানব জীবনের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা। এর চাইতে কঠিন বাস্তবতা নেই। এ থেকে পালাবারও জো নেই। আরেফ বিল্লাহ-গণ এজন্য সব সময় একটি নসিহত দেন, যে নারীর প্রতিচ্ছবি তোমার অন্তর থেকে মুছতে পারছো না, তাকে মৃতদের কাতারে গণ্য করো। মৃত্যু এমন এক কঠিন বিষয়, যা সকল স্বাদ আহ্লাদ ফিকে করে দেয়। সবকিছুর বাস্তবতা চোখের সামনে মেলে ধরে। এর কদর্যতা স্পষ্ট করে তুলে।

নবীজি (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা বেশি পরিমাণে জীবনের স্বাদ হরণকারীর অর্থাৎ মৃত্যুর স্মরণ করো।’ [তিরমিযী (২৩০৭), নাসাঈ (৪/৪)]

(৬) পুরস্কারের প্রতি দৃষ্টি

দৃষ্টি সংযত রাখার বহুবিধ পুরস্কার রয়েছে। এগুলো স্মরণে রাখলে ইনশা আল্লাহ খুব সহজেই দৃষ্টি সংযত রাখতে সক্ষম হবেন। যেমন:

—দৃষ্টি সংযত রাখলে আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তরে নূর সৃষ্টি করবেন। তাঁর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে যে দৃষ্টি অবনত রাখে, তিনি তার অন্তরকে আলোকিত করে দেন। এ নূর দিয়ে সে বাতিলের ভিড়ে সত্যকে খুঁজে পায়, সংশয়-সন্দেহের মুখেই দৃঢ় ঈমানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এমনটাই বলেছেন শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.)।

—দৃষ্টি সংযত রাখা অর্থ নিজের শুদ্ধি করা। দৃষ্টি সংযত রাখতে যে যত বেশি সক্ষম, তার জন্য অন্যান্য হারাম থেকে বেঁচে থাকা ততই সহজ হয়। তাই আল্লাহ তাআলা দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

‘মুমিনদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জা-স্থানের হেফাজত করে; এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র।’ [সূরা নূর, ২৪: ৩০]

—কোনো নিয়ামত ধরে রাখার উপায় হচ্ছে, সেই নিয়ামতের শোকর আদায় করা। বান্দা যখন নিয়ামতের শোকর আদায় করে, আল্লাহ তাআলা তার নিয়ামত বাড়িয়ে দেন এবং এর হেফাজত করেন। কাজেই আপনি যখন দৃষ্টির হেফাজত করছে, তখন মূলত এর নিরাপত্তাই নিশ্চিত করছেন।

—দৃষ্টি সংযত রাখা তাকওয়া পরিচায়ক। আর এই তাকওয়া আপনার বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। আল্লাহ বলেন,

‘আর যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুযী দান করবেন।’ [সূরা ত্বলাক, ৬৫: ২-৩]

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দিক।

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *