যে ১০ কারণে আমল নষ্ট হয়

নেক আমল। মানবজীবনে সবচেয়ে দামী অর্জন। কতটা দামী, তা কবরজীবনের প্রথম রাত্রিতেই প্রতিটা মানুষ টের পায়।

ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজের কথাই চিন্তা করুন, হাদীসে এসেছে দুনিয়ার সবকিছু থেকে এই দুই রাকাত বেশি মূল্যবান! [সহীহ মুসলিম ৭২৫] সাওমের কথা চিন্তা করুন, এর মূল্য এত বেশি যে আল্লাহ তাআলা এই আমলকে নিজের জন্য বলেছেন! বলেছেন, ‘বনী আদমের সব আমল তার নিজের জন্য। কিন্তু সাওম আমার জন্য। আমিই এর প্রতিদান দিবো।’ [মুসলিম ২৫৭১] হজের কথা চিন্তা করুন, এটা এত মূল্যবান যে, হাদীসে এসেছে হজ্জ ব্যক্তির পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়। [মুসলিম ১৭৩] এভাবে যাকাত, সদাচার, দানসদকা থেকে শুরু করে প্রতিটি ভালো কাজের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা এত এত সাওয়াব অর্জনের পথ তৈরি করে রেখেছেন যে, আসমান জমিন ভরিয়ে দিতে সক্ষম।

কিন্তু আমলের এত বিশাল বিশাল পাহাড় গড়ার সুযোগ থাকলেও মুমিনের অসতর্কতার কারণে অনেক সময় তার নেক আমলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় নিয়ে সে আমল করে, ইখলাসের সাথে করে, কিন্তু দিনশেষে সেই আমল তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারে না। অমূল্য আমলগুলোই তখন মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

এজন শাইখ ইবনুস সি’দি (রহ.) বলেছেন, ‘প্রকৃত গরীব তো সে, যে ব্যক্তি আমলের ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে গেছে।’

এমন অনেক কাজ আছে, যা আমাদের আমলগুলোকে এভাবে ভিতরে ভিতরে নষ্ট করে দেয়। অসতর্কতাবশত আমরা যেন সেগুলোতে জড়িয়ে না যাই, তাই আজ আমরা এমন ১০টি বিষয় সম্পর্কে জানবো, যেগুলো আমল নষ্টকারী:

১. আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা

শিরক দুই প্রকার; বড় শিরক এবং ছোট শিরক। এর মধ্যে বড় শিরক করলে ঈমান ও আমল নষ্ট হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহি হয়েছে, তুমি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (সুরা যুমার, আয়াত : ৩৯: ৬৫)

বড় শিরক চার ধরণের: ১) দুআর ক্ষেত্রে শিরক, ২) নিয়তের ক্ষেত্রে শিরক, ৩) আনুগত্যের শিরক, ৪) ভালোবাসার ক্ষেত্রে শিরক। এগুলোর ব্যাপারে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন: ঈমান ধ্বংসের কারণ বইটি।

২. দ্বীনের কোনো বিধানকে অপছন্দ করা, উপহাস করা

রাসূলুল্লাহ (সা.) যে বিধান নিয়ে প্রেরিত হয়েছে, তার কোনো একটি যদি কেউ অপছন্দ করে, তাহলে সে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায় এবং বড় কুফর করে ফেলে। আমাদের সমাজে অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত। পাশ্চাত্য ব্যবস্থাপনার বুলিতে তারা এতটাই মুগ্ধ হয়ে থাকেন যে, দ্বীনের প্রতিষ্ঠিত বিধানগুলো তাদের কাছে সেকেলে লাগে। উদাহরণস্বরূপ: চুরির শাস্তি, মদ-পানকারীর বেত্রাঘাত, কিসাসের বিধান ইত্যাদিকে তারা ন্যায়বিধান হিসেবে মেনে নিতে পারে না। আল্লাহর শরীয়তের এ সকল বিষয়কে তারা অপছন্দ করে। এসব নিয়ে তারা হাসিমজাক করে। নবীজির যুগে মুনাফিকদের এমন স্বভাব ছিল। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যদি তাদের জিজ্ঞেস করো, তোমরা কী কথা বলছিলেন? তাহলে তারা ঝটপট বলে দেবে, আমরা তো কেবল হাসি-তামাশা করছিলাম। তাদের বলো, তোমাদের হাসি-তামাশা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলের সাথে ছিল? এখন আর ওজর পেশ কোরো না। তোমরা ঈমান আনার পর কুফরি করেছ।’ (সূরা তাওবা, ৯: ৬৫-৬৬)

৩. কালো জাদু করা

অধিকাংশ জাদু প্রয়োগ করতে গিয়ে শিরক ও আল্লাহর পরিবর্তে অপবিত্র আত্মাগুলোর নৈকট্য অর্জন করতে হয়। নবীজি সা. এসব কাজকে ঈমান বিধ্বংসী বলেছেন এবং তাকে শিরকের সাথে যুক্ত করেছেন। হাদীসে এসেছে, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংস্কারী বস্তু থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলো কী? নবীজি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, জাদু করা…’ (বুখারী ২৭৬৬, মুসলিম ৮৯)

আজকাল কালো জাদু করার প্রবণতা বেড়ে গেছে মুসলিম ঘরগুলোতে। বিয়ে ভাঙ্গা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট করা, প্রেমের ফাঁদে ফেলা, ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ ঘটানো, ইত্যাদি কাজে বর্তমানে মানুষ জাদুকরদের দ্বারস্থ হয় এবং মনের অজান্তেই নিজেদের ঈমান, আমল নষ্ট করে আসে। জাদুর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পড়ুন: জাদুর বাস্তবতা

৪. হাদীস অস্বীকার করা

বর্তমানে একটি দল বের হয়েছে, যারা কুরআন-হাদীসকে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করে। কুরআনের বাহ্যিক অর্থ পড়ে নিজেদের মতো বুঝতে চায় এবং তাদের বুঝের সাথে সাংঘর্ষিক এমন সকল বিশুদ্ধ হাদীসকে তারা অস্বীকার করে। এছাড়া হাদীসের সহীহ, যইফ, মাওযু প্রকারভেদের অজুহাতে হাদীস অস্বীকার করে। মূলত হাদীস সংকলনের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং একশ্রেণীর বিভ্রান্ত মানুষের অপপ্রচারের শিকার হয়ে তারা এই ফাঁদে পড়ে। অথচ হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা। দ্বিতীয় ওয়াহি। ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস। শরীয়তের প্রায় সব আমল ও পদ্ধতি হাদীসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। এটাকে অস্বীকার করা মানে সরাসরি শরীয়তকেই অস্বীকার করার নামান্তর। ‘শুধু কুরআন মানি, হাদীস মানি না’ দাবী করলে কারও ঈমান থাকে না। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে এবং সংশয় কাটাতে পড়তে পারেন হাদীছ অস্বীকারকারীদের সংশয় নিরসন বইটি।

৫. কাফিরকে কাফির না জানা

অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে বর্তমানে এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে হলিউড বলিউড প্রজন্মের কাছে অমুসলিমরা তারকার ন্যায়। তাদেরকে কাফির জ্ঞান করা তো দূরের কথা, তাদের মৃত্যুকে RIP দুআর স্রোত বয়ে যায় মুসলিমদের মহলে। অথচ মুসলিম ছাড়া সকল আহলে কিতাব, মুশরিক, ধর্মত্যাগী ও অন্যান্য শ্রেণী যাদেরকে আল্লাহ কাফির বলেছেন, তাদেরকে কাফির জানা আবশ্যক। কারণ, বিষয়টি তাওহীদের সাথে সম্পৃক্ত। আপনি যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তখন আল্লাহ ছাড়া সকল মিথ্যা উপাসক এবং তাদের উপাসনাকারীদের অস্বীকার করছেন। তাদেরকে ভ্রান্ত জ্ঞান করছেন। তাই আপনি যখন তাদের কাফির হওয়া নিয়ে সন্দেহে পড়েন, RIP বলে জান্নাতের দুআ করেন, তখন সেটা সরাসরি আপনার তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।

৬. পরকাল অস্বীকার করা

পরকাল অস্বীকার করলে আমল নষ্ট হয়ে যায়। পরকাল বলে কিছু নেই—এরূপ বলা, কিয়ামত আদৌ হবে কিনা এবং হাশরের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা—এগুলো ঈমান, আমল নষ্ট করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আমার নিদর্শন ও আখিরাতের সাক্ষাৎ অস্বীকার করে তাদের কাজ নিষ্ফল হয়। তারা যা করে সে অনুযায়ীই তাদের প্রতিফল দেওয়া হবে।’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৪৭)

দীর্ঘদিন দ্বীন থেকে দূরে থাকার কারণে পরকালের প্রতি ঈমান দুর্বল হতে পারে। তাই বলে পরকালকে অস্বীকার করা, পরকাল নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা একজন মুসলিমের সাথে শোভা পায় না। এক্ষেত্রে পরকালের প্রতি ঈমান বাড়ায় এমন লেকচার শোনা যেতে পারে, পরকাল বিষয়ক সুন্দর সুন্দর বই পড়া যেতে পারে, যেগুলো আমাদের দুর্বল ঈমানকে তাজা করতে সক্ষম। যেমন: পরকাল-LIFE AFTER LIFE, কেয়ামত, জীবনের ওপারে

৭. আল্লাহ বা তাঁর রাসূলকে গালি দেয়া

আধুনিক যুগে অজ্ঞেয়বাদীদের মধ্যে এই চর্চা অত্যন্ত প্রবল। তারা সীরাতের ঘটনাকে বাজেভাবে ব্যাখ্যা করে এবং আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর ওপর অপবাদ রটায়। গালি দেয়। অন্যদিকে যারা এসব করে, তাদেরকে অনেক নামধারী মুসলিম পছন্দও করে। তাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে। অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধে কোনো কুমন্তব্য করা, গালি দেয়া, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা কটাক্ষ করা বড় কুফরী। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তো তাদেরকে দুনিয়াতে ও আখিরাতে অভিশপ্ত করেন এবং তিনি তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (আহযাব: ৫৭)

৮. বিদআত করা

বিদআত হলো দ্বীনের নামে নবউদ্ভাবিত বিষয়সমূহ, যেগুলো মানুষ সাওয়াবের উদ্দেশ্যে করে, অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এ ব্যাপারে অনুমোদন দেন নি। হাদীসে এসেছে, ‘‘যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করবে, যে বিষয়ে আমার অনুমোদন নেই, তা আমলকারীর উপর প্রত্যাখ্যাত হবে।’’ (সহীহ মুসলিম, ১৭১৮) বিদআত বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন ড. আহমদ আলীর সিরিজ- বিদআত – ৭ খণ্ড একসাথে

৯. লোকদেখানো আমল করা

রিয়া (الرياء) অর্থ প্রদর্শন করা বা প্রদর্শনেচ্ছা। আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদত পালনের মধ্যে মানুষের দর্শন, প্রশংসা বা বাহবার ইচ্ছা পোষণ করাকে রিয়া বলে। মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামী বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ ‘রিয়া’। কুরআন-হাদীসে রিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তাদের একজন বড় আলিম, একজন প্রসিদ্ধ শহীদ ও একজন বড় দাতা। তারা আজীবন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে কাটালেও রিয়ার কারণে তারা ধ্বংসগ্রস্ত হয়। (মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫১৩) রিয়া বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন ইমাম গাযালী (রহ.)-এর রিয়া (লোক দেখানো ইবাদত) বইটি।

১০. গোপনে পাপ করা

গোপন পাপের কারণে ঈমান ভঙ্গ না হলেও ব্যক্তি নেক আমল নষ্ট হয়ে যায়। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি যারা কিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বলেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতো ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে একান্ত গোপনে আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৪৫)

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *