তাওয়াক্কুল: যেভাবে করতে হয়

আল কুরআনুল কারীমে যখন কোনো বিষয়ের উল্লেখ আসে, তখন সে বিষয়টি এমনিতেই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। আর সমগ্র কুরআন জুড়ে বিষয়টির উল্লেখ যদি হয় ত্রিশবারেরও বেশি, তাহলে এর গুরুত্ব কতোখানি তা আর আলাদা করে বলতে হয় না। বলছিলাম তাওয়াক্কুল ‘আলাল্লাহ তথা আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা। ঈমানের সাথে তাওয়াক্কুল জড়িয়ে আছে একদম অঙ্গাঙ্গীভাবে। কুরআনে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে বারবার বলা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর উপরই তাওয়াক্কুল করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাতেও বারবার উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা।

সূরা আলে ইমরানের ১৬০ নং আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ ইরশাদ করছেন –

وَعَلَى ٱللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ ٱلْمُؤْمِنُونَ

অর্থ : আর ঈমানদারদের উচিত আল্লাহর উপরই ভরসা করা।

এই একই শব্দে সূরা মায়িদাহর ১১ নং আয়াতের শেষাংশেও আল্লাহ মুমিনদের আদেশ দিয়েছেন তাঁর উপরই যেন তারা ভরসা করে। এভাবে সূরা আত-তাওবাহর একেবারে শেষ আয়াতটিতে তাওয়াক্কুলের গভীরতা, এর দৃপ্ত প্রত্যয় যেন আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন –

فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَقُلْ حَسْبِىَ ٱللَّهُ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَهُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْعَظِيمِ

অর্থ : “এ সত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলে দাও—আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তাঁরই উপর আমি ভরসা করি আর তিনিই হলেন মহান আরশের রব।”

এভাবে কুরআন জুড়ে ৩৫ বার আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের উল্লেখ পাওয়া যায়।

একইভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসেও আপনি দেখবেন তাওয়াক্কুল করার কি অপার মহিমা! এ সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত হাদীসটিই আপনাদের তাহলে শোনাই।

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

“তোমরা যদি সঠিকভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে, তাহলে তিনি তোমাদের সেভাবে রিযক দিতেন, যেভাবে তিনি পাখিদের রিযক দিয়ে থাকেন—তারা সকালবেলা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যায় ফিরে আসে ভরা পেটে।” [তিরমিযী, ২৩৪৪, হাসান সহীহ]

সালাফের যবানিতেও আমরা শুনতে পাই তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য। প্রখ্যাত তাবে’ঈ সাঈদ ইবনু জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ঈমানের সারনির্যাস হলো আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল।”

তাওয়াক্কুল যেভাবে করতে হয়

ইসলামে যখন কোনো একটা বিষয়ের কথা বলা হয়, তখন সেই বিষয়ে পরিপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়। আল্লাহর উপর ভরসার স্বরূপ কেমন, সেই বিষয়েও আল্লাহর রাসূলের হাদীস থেকে নির্দেশনা পাই আমরা। ভরসা করার কথা বললে অনেকেই ভাবে যে এখানে আর আমার নিজ থেকে কিছু করার নেই। যার উপর ভরসা করা হয়েছে তিনিই সব করবেন। অথচ এটা একটা হাস্যকর রকমের ভুল ধারণা। আল্লাহর উপর ভরসা কীভাবে করতে হয়, সেটা আমরা আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের জীবন থেকেই শিখতে পারি। তবে সেদিকে যাবার আগে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীস ও উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর একটি উক্তি এখানে তুলে দিচ্ছি।

১। আনাস ইবনু মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে (তার বাহন দেখিয়ে) জিজ্ঞাসা করে, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি এটি বাঁধার পর তাওয়াক্কুল করবো, নাকি এটি ছেড়ে রেখে তাওয়াক্কুল করবো?” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“এটি বেঁধে নাও; তারপর তাওয়াক্কুল করো।” [তিরমিযী, ২৫১৭]

২। মু’আবিয়া ইবনু কুররা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, “উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে কয়েকজন ইয়ামানি লোকের দেখা হলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “তোমরা কারা?” তারা বলে, “আমরা হলাম তাওয়াক্কুলকারী।” উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “তোমরা বরং অলস বসে থাকা লোক! তাওয়াক্কুলকারী তো সে, যে যমীনে বীজ ফেলে, তারপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে!”

এই দুটি বর্ণনা থেকে তাওয়াক্কুলের স্বরূপ একদম স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা। আমরা যে সমস্ত কাজগুলো করে থাকি, সেগুলো পৃথিবীতে আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়মের মধ্যেই করতে হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা দিয়েই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। লোকটি নবীজির কাছে জানতে চেয়েছিল তাওয়াক্কুলের ধরন সম্পর্কে। নবীজি সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন আগে নিজের বাহনকে বেঁধে রাখতে হবে, এরপরই তাওয়াক্কুল করতে হবে। কারণ, এটাই আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়ম। আল্লাহ এই নিয়ম ঠিক করে দিয়েছেন যে ঘোড়া বা উটকে যদি এদিক-সেদিক চলে যাওয়া থেকে আটকে রাখতে হয়, তবে তাকে বেঁধে রাখতে হবে। কিন্তু এই কাজে ব্যবহৃত দড়ি বা অন্যকিছুর এই ক্ষমতা নেই যে সেটি ওই ঘোড়া বা উটকে ধরে রাখবে। যদি আল্লাহ ওই দড়ির মাধ্যমে ঘোড়া বা উটটিকে ধরে না রাখেন, তবে দড়ির কোনো ক্ষমতা নেই সে প্রাণীটিকে আটকে রাখে। এটাই হচ্ছে তাওয়াক্কুলের রহস্য।

তাই তাওয়াক্কুল মানে বসে থাকা নয়। তাওয়াক্কুল মানে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহর নামে আল্লাহরই দেওয়া আসবাব বা উপকরণ ব্যবহার করে কাজ শুরু করা ও সম্পন্ন করা এবং ফলাফলের জন্য দুনিয়াবি এসব উপকরণের উপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র আল্লাহর উপরই নির্ভর করা। কারণ, যদি আল্লাহ এসব উপকরণ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বের করে না আনেন, তবে এদের নিজেদের এই শক্তি নেই যে তারা নিজ থেকে আপনাকে ফলাফল এনে দেবে।

উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথাটি খেয়াল করে দেখুন। তিনিও ঠিক একই কথা বলছেন। একদল লোক, যারা কিনা অলস বসে থেকে, হাত-পা গুটিয়ে রেখে নিজেদের তাওয়াক্কুলকারী ভাবছে, সেখানে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে সুস্পষ্ট ভাষায় অভিহিত করেছেন ‘অলস বসে থাকা লোক’ হিসেবে। এরপর বিষয়টিকে তিনি আরো পরিষ্কার করে দিয়েছেন সুন্দর একটি উদাহরণের মাধ্যমে—তাওয়াক্কুলকারী হচ্ছে সে যে যমীনে বীজ ফেলে আর এরপর গিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে।

তাই আমরা অবশ্যই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলকারী হবো। নিশ্চয়ই তাওয়াক্কুলের সম্পর্ক সরাসরি তাওহীদের সাথে। কিন্তু আমরা যেন তাওয়াক্কুলের প্রকৃত অর্থ বুঝে তারপরই তাওয়াক্কুল করি। একজন সালাফ বলেছিলেন, তাওয়াক্কুল হচ্ছে আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা। আমরা যেন জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর সঠিকভাবে তাওয়াক্কুল করতে পারি। হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে আমাদের উপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমরা যেন সেটা সঠিকভাবে পালন করি এবং ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপরই নির্ভর করি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তাওয়াক্কুলের আমল করে আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। তিনি খাবারের জন্য আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকেননি। তিনি নিজে শ্রম দিয়েছেন এবং নিজের পরিশ্রমের উপার্জন দিয়ে খাবার কিনে এনেছেন। এটাই ছিল আল্লাহর উপর ভরসা করার সত্যিকারের নমুনা।

বদরের যুদ্ধের কথাই না হয় ভাবুন। তাওয়াক্কুলের কি অপরূপ নমুনাই না সেদিন দেখিয়েছিলেন আল্লাহর রাসূল! তিনি তাঁর সাহাবীদের একত্র করেছেন, তাঁদের সারিবদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের জন্য তাঁর সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রস্তুতিটুকু সম্পন্ন করেছেন এবং সব প্রস্তুতি শেষ হবার পর আল্লাহর দরবারে আকুল হয়ে কেঁদেছেন। নিজের সর্বোচ্চ ব্যাকুলতা ঢেলে দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে বিজয় কামনা করেছেন। তিনি কি পারতেন না যুদ্ধ না করে, হাত গুটিয়ে বসে থেকে শুধু আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে? তিনি তো সেই মানুষ, যাঁর দু’আ আল্লাহ ফিরিয়ে দিতেন না। কিন্তু না, তিনি এমনটি করেননি। কারণ তিনি জানতেন আল্লাহর উপর ভরসা করার প্রকৃত অর্থ কী আর তিনি সেটিই করেছিলেন। এরপরও কি আমরা ভেবে নেবো তাওয়াক্কুল মানে স্রেফ শুয়েবসে আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দেওয়া?

মুমিনের জীবনটাই হচ্ছে তাওয়াক্কুলের জীবন। এই জীবনের পাঠ সে নিয়েছে আল্লাহর কিতাবের পাতা, আল্লাহর রাসূল আর সাহাবায়ে কেরামের কর্মমুখর জীবন থেকে। তাই আসুন, আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে মন দেই, নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সফলতার জন্য চেষ্টা করে যাই এবং সবশেষে ফলাফলের জন্য উপায়-উপকরণ আর নিজের চেষ্টার উপর নির্ভর না করে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল হই। তবেই আমরা হতে পারবো প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারী, হবো সত্যিকারের ভরসাকারী। আল্লাহ আমাদের হিদায়াত দিন। আমীন।

তাওয়াক্কুল বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন:

আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল – ইমাম ইবনু আবিদ দুনইয়া (রহ.)
তাওয়াক্কুল – ড. ইউসুফ আল কারযাভী

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *