নবীজির ছয়টি অসিয়ত

সাহাবী আবূ যর আল-গিফারী (রাযি.) বলেন,
আমার বন্ধু (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে কিছু ভালো অভ্যাস গড়ার অসীয়ত করেছেন:

প্রথমত, জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে আমার ওপরে রয়েছে, আমি যেন তার দিকে না তাকাই, বরং নিচের দিকে তাকাই।

মানসিক প্রশান্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পরিতৃপ্ত থাকা। পরিতৃপ্ত মন বর্তমান নিয়ে অভিযোগ করে না এবং অতীত নিয়েও হায়হতাশ করা থেকে বিরত থাকে। তাকদীর নিয়ে সে দোটানায় ভোগা তো দূরে থাক, অল্পতেই সে তুষ্ট হয়। মনের প্রদান দরজা দৃষ্টি। দৃষ্টির দরজা দিয়েই মনে নানান চিন্তা উদয় হয়। তাই মনকে পরিতৃপ্ত রাখতে দৃষ্টির ওপর লাগাম পরানো জরুরী। আর এর শুরুটা হতে পারে, জাগতিক অবস্থান থেকে যে আপনার ওপরে রয়েছে, তার দিকে না তাকিয়ে যে আপনার নিচে রয়েছে, তার দিকে তাকান। তাহলে ভালো থাকবেন, মানসিকভাবেও স্বস্তি অনুভব করবেন।

দ্বিতীয় অসীয়ত করেছেন, আমি যেন গরীব দুখীদের ভালোবাসি।

গরীব দুখীদের ভালোবাসার সুফল অনেক। একটি হলো, আত্মগরিমা থেকে বেঁচে থাকা যায়। মনে তখন অহংকার আসে না। নিজেকে অন্যদের মতই সাধারণ দাস মনে হয়। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রত্যেক নবীই এই আদর্শ লালন করতেন। তাছাড়া তাদের ওপর ঈমান আনা অধিকাংশ মানুষও ছিল গরীব দুখী। হাদীসে এসেছে, গরীব দুখীরা জান্নাতে আগে আগে দৌঁড়াবে, যখন ধনীরা হিসেব দিতে দিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, গরীব মুমিনরা ধনীদের পাঁচশত বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী ২৩৫১) কাজেই গরীবদের ভালোবাসুন, তাদের সময় দিন।

আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি যেন আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করি।

ইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার শিক্ষা দেখায়। বৈরাগ্যবাদ, বিচ্ছিন্নতাকে পরিহার করে। ইসলামে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার গুনাহ এজন্যই খুব মারাত্মক। কোনো কোনো হাদীসে তো সরাসরি এসেছে, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী,৫৯৮৪; সহীহ মুসলিম, ২৫৫৬) তাই আবূ যর গিফারীকে নবীজি জোর দিয়ে বলেছেন, আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নিলেও তুমি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে।

আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া যেন না করি।

মানুষ অন্যের মন্তব্য দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়। এটা আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দ্বীন পালনের বেলায় সবার ওপর থাকবেন আল্লাহর ভালোবাসা। তাঁর সম্মান সবার ওপর। তাঁর সন্তুষ্টি সবার আগে। কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া এ ক্ষেত্রে করা যাবে না। আয়েশা (রাযি.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: মানুষ নাখোশ হলেও যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করে, মানুষের বিপরীতে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।’ (তিরমিযী, হাদিস : ২৪১৪)

হক কথা তিক্ত, কষ্টদায়ক শোনালেও আমি যেন হক কথাই বলি।

এর উপকারিতা নবীজি (ﷺ) আরেক হাদীসে বলেছেন: ‘হক বা সত্য পুণ্যের পথ দেখায় এবং পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। একজন মানুষ (অবিরত) সত্য বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তাকে খুব সত্যবাদী হিসেবে লেখা হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা পাপের পথ দেখায় এবং পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। একজন মানুষ (সর্বদা) মিথ্যা বলতে থাকে, শেষ অবধি আল্লাহর কাছে তাকে মহা মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।’ (বুখারী ৬০৯৪; মুসলিম ৬৮০৩, ৬৮০৫; আবু দাউদ, তিরমিযী)

পরিশেষে আমাকে অসীয়ত করেছেন, আমি যেন বেশি বেশি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়ি। কারণ, এটি জান্নাতের অসংখ্য খাজানার একটি।

এই বাক্যের সাধারণ অর্থ, মহান আল্লাহর সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযি.) এর অর্থ করেছেন: আল্লাহ যদি কাউকে না বাঁচান, তাহলে কারও পক্ষে তাঁর অবাধ্যতা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। তেমনি আল্লাহ্‌ যদি কাউকে সাহায্য না করেন, তাঁর আনুগত্যে কেউ শক্তি পাবে না।’ (শারহ মুসলিম, ৪/৮৭) বেশি বেশি এই বাক্য দিয়ে যিকির করার ফায়দা হচ্ছে, মন তখন আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখে। আমল করে যেমন আত্মতুষ্টিতে ভোগে না, তেমনি পাপ হলেও হাল ছেড়ে দেয় না। তপের মুখে নিজেকে ধরে রাখতে পারে। কোনো কোনো সালাফ বলতেন, ‘যে ব্যক্তি এই যিকির করে, আল্লাহ তাআলা তার থেকে সত্তর প্রকারের অনিষ্ট দূর করে দেন এবং এগুলোর মাঝে সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিপদ হলো দরিদ্রতা।’ (তিরমিযী, ৩৬০১)

আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদেরকে নবীজির এই ছয়টি অসিয়ত অনুযায়ী জীবন গড়ার তাওফীক দান করুক।

হাদীসের সূত্র: সহীহ আল-হিব্বান (৪৪৯), সনদ সহীহ: শাইখ শুয়াইব আল-আনরাউত

নবীজির এরকম আরও অসীয়ত পেতে এই লিংকের বইগুলো সংগ্রহে রাখতে পারেন: ৫টি নির্বাচিত হাদীসের বই

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *