গাইরত: মুমিনের আত্মসম্মান

হিজরি ২৮৬ সাল। আজ থেকে প্রায় ১২ শত বছর আগের কথা। তেহরানে অবস্থিত বর্তমান ‘রয়’ শহর তখন খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত। বহু বিখ্যাত মনিষীদের জন্মস্থান। তাদের পদচারণে মুখরিত শহরের প্রতিটি অলিগলি। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন মূসা বিন ইসহাক। সেই বছর তাঁর আদালতে এক নারী মামলা টুকে। তাও আবার নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে। যাইহোক, হাজিরার দিন নারীর পক্ষের উকিলকে ডাকা হলো। উকিল তার নারী মক্কেলের পক্ষ থেকে দাবী উপস্থাপন করল, মক্কেলকে মোহরানা বাবদ ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা স্বামীর পরিশোধ করতে হবে। মক্কেলের স্বামী তখন আদালতেই উপস্থিত। কিন্তু সে এত বড় অঙ্ক পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানালো। বিচারপতি নারীর উকিলকে ডাকলেন।

— তোমাদের সাক্ষীরা কোথায়? আদালতে এসেছে?
— জি হুজুর, তারা সবাই এখানে উপস্থিত আছে।

তার আগে একটু বলে নিই, সেই বাদী নারী পর্দাবৃত ছিল এবং চেহারাও নিকাবে ঢাকা। কিন্তু আদালতে নিয়ম হচ্ছে, বাদীর দিকে তাকিয়ে সাক্ষীকে স্বীকৃতি দিতে হয় এবং সাক্ষ্যদান-কালে তার দিকে ইশারা করতে হয়। তাই উকিল সাহেব একজন সাক্ষীকে বলল, সে যেন সেই নারীর দিকে তাকায় এবং তার মক্কেলের চেহারা সনাক্ত করে।

এ কথা শুনে স্বামী উত্তেজিত হয়ে পড়ল। যদিও সে বিবাদী। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল:
— এসব কী হচ্ছে! কী শুরু করলেন আপনারা!?
— সাক্ষীরা আপনার স্ত্রীর চেহারা দেখবেন। যেন তাদের পক্ষে আপনার স্ত্রীর পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়। প্রয়োজনের খাতিরেই এমনটা করা হচ্ছে। উকিল ব্যাখ্যা করল।

‘থামুন আপনারা।’ রাগে অগ্নিশর্মা স্বামী। ‘আমি বিচারক মহোদয়কে সামনে রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছি, মোহরানা বাবদ আমার স্ত্রী যে পরিমাণ অর্থ দাবি করেছে, আমি পুরোটাই পরিশোধ করতে রাজি; তবুও সে যেন তার নিকাব না সরায়!’

স্বামীর গাইরত (আত্মমর্যাদা) দেখে স্ত্রীও বলে উঠল, ‘আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমার মোহর তাকে দান করে দিলাম। সেই সাথে দুনিয়া ও আখিরাতে এ ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে তাকে দায়মুক্ত ঘোষণা দিলাম!’

স্বামী-স্ত্রীর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল গোটা আদালত। এ কী বলছে তারা! বিচারক মূসা বিন ইসহাক বিস্ময়-সুরে বলেই উঠলেন, ‘আপনাদের দুজনের গাইরত দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। বইপত্রে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হোক। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, মুসলিমদের আখলাক কেমন ছিল।’

(সূত্র: তারিখে বাগদাদ : ১৫/৩৫, খতিব আবু বকর)

আত্মসম্মান এবং লজ্জা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন লজ্জা থাকে না, তখন আত্মসম্মানও থাকে না। যুগের পরিক্রমায়, আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আজ সেই লজ্জা আমরা হারাতে বসেছি। ভুলে গিয়েছি নিজেদের পরিচয়, শান-সৌকত। ফলে নির্লজ্জতা, বেহায়াপনায় ছেয়ে যাচ্ছে এই উম্মাহ। যেই জাতি তাদের নারীদের চেহারাটুকু পর পুরুষদের দেখতে দিত না, সেই জাতিই আজ অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় তাদের বাহিরে যেতে দেয়। অবাধ মেলামেশা, অশ্লীলতা, পর্ন আসক্তির মতো কুৎসিত অভ্যাসে যারা অভ্যস্ত, পশ্চিমাদের নির্ধারিত নৈতিকতার মানদণ্ডে যারা নিজেদের মস্তিষ্ককে বাক্সবন্দী করে রেখেছে, তাদেরকে কীভাবে বোঝাবেন তাদের আসল সম্মান কোথায়? কীভাবে তাদেরকে আসল স্বাধীনতা চেনাবেন, অথচ প্রবৃত্তির কাছে তাদের বিবেক নতিস্বীকার করেছে? ভোগবাদী জীবনকেই সাফল্য হিসেবে নিয়েছে?

প্রয়োজন লজ্জা। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ যে লজ্জাবোধ নিয়ে বেড়ে উঠে, এই লজ্জাকেই জাগিয়ে তুলতে হবে। লজ্জাই পারে আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে, ইসলামের বাকি আখলাকগুলো পুনর্জীবিত করতে। স্রষ্টার প্রতি লজ্জা, সৃষ্টির প্রতি লজ্জা, নিজের প্রতি লজ্জা। ধাপে ধাপে লজ্জার এই প্রকারগুলো যদি আমরা নিজেদের ভিতর জাগিয়ে তুলতে পারি, ইনশা আল্লাহ্‌ একজন ভালো মানুষ হবার পাশাপাশি ভালো বান্দাও হতে পারব। এটি একটি বাতিঘর, যা দিশেহারা অন্তরকে পথ দেখায়। শক্তি যোগায় অন্যায় থেকে দূরে থাকতে এবং উদ্বুদ্ধ করে তার দায়িত্ব পালনে।

লজ্জা কী, কত প্রকার, কীভাবে এটি অর্জন করতে হয়, পূর্বসূরিগণ কেমন লজ্জার চর্চা করতেন, এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন শাইখ মুহাম্মাদ ইসমাঈল আল-মুকাদ্দাম-এর বই ‘লজ্জা: ঈমানের একটি শাখা’। ইনশা আল্লাহ্‌ খুব শীঘ্রই আসবে ওয়াফি পাবলিকেশন থেকে।

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *