জান্নাতের চাবি

ছোটবেলা থেকেই আমরা একটি কথা শুনে এনেছি, যে “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রসূলুহ” উচ্চারণ করে, সে কখনও জাহান্নামে যাবে না। অনেকে মনে করে, জান্নাতে প্রবেশের জন্য এই দুই শাহাদাহ পাঠই যথেষ্ট। কারণ, জান্নাতের চাবি শাহাদাহ।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জান্নাতের দরজা খোলার জন্য শুধু বাক্য উচ্চারণ করাই যথেষ্ট না। বরং এই বাক্যের শর্ত এবং দাবী পূরণ করা আবশ্যক। চাবির যেমন দাঁত থাকে, আলিমগণের ভাষায় এই শর্তগুলো সেই দাঁত। দাঁত ছাড়া চাবি অকেজো, তেমনি শর্তপূরণ ছাড়া এই বাক্য আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। কথাটা শুনতে অনেকের কাছে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য, ইসলাম নিছক কিছু শব্দাবলীর উচ্চারণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আল্লাহর পণ্য অনেক দামী, আর আল্লাহর পণ্য জান্নাত। এই সওদা মোটেও সস্তা নয়।

কেন জানেন? আল্লাহ চান আমরা ইসলামকে লালন করি। এই বিশ্বাস, এই তাওহীদের কালিমার ছাপ আমাদের প্রতিটি কাজ কর্মে থাকুক। প্রতিটি চিন্তায়, প্রতিটি সম্পর্কে, আচার ব্যবহারে যেন আমরা আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয় দেই। স্রেফ কিছু তত্ত্ব কথা বোঝানোর জন্য আল্লাহর নবী বলেন নি ‘মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ গণিত পরীক্ষায় পাশ করতে হলে যেমন সূত্র জানতে হয়, পাশাপাশি এর সঠিক প্রয়োগও জানতে হয়। জান্নাতের সূত্র হলো তাওহীদের কালিমা, আর এই সূত্রকে প্রয়োগ করতে পারলেই মিলবে জান্নাত।

সূত্র প্রয়োগের । আসুন এক নজরে এর দাবীগুলো জেনে নিই:

(১) ইলম

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর অর্থ জানা। অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর ইবাদতে কাউকে শরীক না করা। তাঁর রাজত্বে, তাঁর প্রভুত্বে কাউকে অংশীদার না বানানো। তবে শিরক, কুফর কি শুধু মূর্তি পূজা করলেই হয়? শুধু কবরে সিজদা দিলেই? না, এর বহুমুখী ধরণ আছে, কালের পরিক্রমায় নিত্যনতুন শিরকের রাস্তা খুলে দেয় ইবলিশ। তাই এই সম্বন্ধে জানতে হবে এবং নিজের এই বিশ্বাসকে কলুষিত-মুক্ত রাখতে হবে।

(২) ইয়াকীন

ইয়াকীন বা দৃঢ় বিশ্বাস। আজকের এই সংশয়ের যুগে মানুষ উঠতে বসতে দ্বীন নিয়ে সংশয় ভোগে। আল্লাহর আইন নিয়ে, হিজাব নিকাব নিয়ে, সম্পদের ভাগ, পুরুষদের জন্য জান্নাতের হুর, একাধিক বিবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলো যখন আসে, আমরা অনেকেই সংশয়ের মুখে পড়ে যাই। কেউ কেউ সরাসরি নাকচ করে দেই, বলি ‘এগুলো এই যুগে সেকেলে/অন্যায়/অবিচার’ ইত্যাদি। ফলে আল্লাহর বিধান নাকচের শামিল হয় আমাদের এই কথাবার্তা। আবার কেউ আছি এগুলো নিয়ে সংশয়ে ভুগি। ইয়াকীন এসবের ঊর্ধ্বে।

(৩) কুবূল

কুবূল বা মেনে নেয়া। অর্থাৎ তাওহীদের শিক্ষাকে মন থেকে যেভাবে মেনে নিতে হবে, তেমনি মুখেও স্বীকার করতে হবে। কেউ মনে মনে বিশ্বাস করে আল্লাহ এক, ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম; আবার মুখে এটাও বলে, যারা মূর্তি পূজা করে, ক্রুশের পূজা করে, তাদের ধর্মও সঠিক। তাহলে এটা কুবূল হলো না। বরং নিফাকীর পরিচয়।

(৪) সিদক্ব

বাংলায় যাকে বলে সত্যবাদিতা। এটা হলো মুখে তাওহীদের কথা স্বীকার করা, অন্তরেও স্বীকার করা। কিন্তু অন্তর যদি সংশয়গ্রস্ত থাকে, ‘হতে পারে, নাও হতে পারে’ টাইপ দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে—তাহলে এটি সত্যবাদিতার বিপরীত। তাওহীদের কালিমার শর্ত হচ্ছে অন্তরে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না। আর তাই যেসব বিষয়ে মনে সন্দেহ জাগে, সংশয়ের দানা বাধে, সেগুলোর সঠিক উত্তর জানার জন্য ‘ইলম’ অন্বেষণ করতে হবে। বিজ্ঞ আলিমদের শরণাপন্ন হতে হবে, আকীদার বই পড়তে হবে। অধিকাংশ সময় আমাদের অন্তর সংশয় দ্বারা আক্রান্ত হয় মূলত এজন্যই যে, আমরা আমাদের আকীদা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জানি না, তাওহীদের কালিমার অর্থ জানি না, শর্ত-দাবীগুলো জানি না, মুসলিম হবার যৌক্তিকতা জিজ্ঞেস করলে বুঝিয়ে বলতে পারি না।

(৫) মাহাব্বাহ

অর্থাৎ ভালোবাসা। ঈমানের দাবী হচ্ছে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব গড়া, আল্লাহর জন্য শত্রুতা। কোনো দল মতের ভিত্তিতে নয়, কোনো ভূমি সীমানার ভিত্তিতে নয়। সারা পৃথিবীর মুমিনরা হবে এক দেহের মতো, আর এই সম্পর্কের মূল কেন্দ্র হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

(৬) ইনকিয়াদ

অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। নবীজি (ﷺ)-এর আনুগত্য করা। এই দ্বীন বিশ্বাস এবং আমলের সমন্বিত রূপ। বরং বিশ্বাসকে সত্যায়িত করার মাধ্যমই হচ্ছে আমল। আর এ জন্য কুরআনের যত জায়গায় ঈমানের কথা এসেছে, পাশাপাশি আমলের কথাও এসেছে।

(৭) ইখলাস

আপনার ঈমান আছে, আমলও আছে, কিন্তু এগুলো লোক দেখানো। মানুষের প্রশংসা কুড়োবার জন্য আমল করলেন, দুনিয়ার ক্ষণিকের লাভের জন্য নিজেকে মুমিন প্রমাণ করলেন, এমনটা হওয়া যাবে না। বিশ্বাস, আমল, সবগুলোই হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।

এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন:
কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা
তাওহিদের মূলনীতি
স্রষ্টা ধর্ম জীবন

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *