আল্লাহর কালাম আল কুরআন। মহিমান্বিত এই কিতাবের মাধ্যমেই পরিচালিত হবে আমাদের জীবন। সেজন্য কুরআন জানা, কুরআন বোঝা ও এর মর্মের গভীরে প্রবেশ করা একান্ত জরুরী। কুরআনের অর্থ ও মর্ম উপলব্ধির জন্য উম্মতের মহীরুহ আলিমরা লিখেছেন অনেকগুলো তাফসীর। সেগুলোতে তাঁরা লিখেছেন কুরআনের গভীরতম উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। যুগ যুগ ধরে উম্মাহ উপকৃত হচ্ছে এই অসাধারণ কাজগুলোর মাধ্যমে। আজ আমরা আপনাদেরকে এমন তিনটি তাফসীরের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছি, ইনশাআল্লাহ।
১। তাফসীরে উসমানী (১-৩ খণ্ড)
শুরুটা করা যাক উপমহাদেশীয় একটি তাফসীরের মাধ্যমে। এটিকে বলা হয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ তাফসীরগ্রন্থ। ৩ খণ্ডে সমাপ্ত এই তাফসীরটি ‘তাফসীরে উসমানী’ নামে পরিচিত। এর রচনায় আছেন অত্যন্ত উঁচুমাপের দুজন বরেণ্য আলিম, যাঁদেরকে সবাই এক নামে চেনে। একজন হলেন মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী রাহিমাহুল্লাহ এবং আরেকজন হলেন শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহিমাহুল্লাহ। পুরো কুরআনের তরজমা ও সূরা ফাতিহা, সূরা বাক্বারা ও সূরা আন-নিসার তাফসীর লিখেছেন শাইখুল হিন্দ। আর সূরা আলে ইমরান ও সূরা মায়েদা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত তাফসীর লিখেছেন শাইখ উসমানী। এই চমৎকার তাফসীরটির পূর্ণাঙ্গ ও পরিমার্জিত সংস্করণের সাথে শাইখ তাকী উসমানী, শাইখ আবদুল মালেক সহ অনেক বড় বড় নাম জড়িত রয়েছে। অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন কুরআনের একনিষ্ঠ একজন ছাত্র মাওলানা গিয়াসুদ্দিন আহমাদ। তাফসীরটির শুরুতে তিনি এই তাফসীরের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলোই আমরা পাঠকের সমীপে তুলে ধরছি।
এই তাফসীরটি তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অর্থ-মর্মের দিক থেকে গভীরতায় পূর্ণ। সংক্ষিপ্ত হলেও প্রয়োজনের জায়গায় ঠিকই বিশদাকারে ব্যাখ্যা এসেছে। কুরআনের বিষয়াবলী সম্পর্কে সুন্দর একটি ধারণা দেবে আপনাকে এই তাফসীরটি। কঠিন আলোচনাগুলো পেশ করতে গিয়ে ভাষার প্রাঞ্জলতার দিকে লক্ষ্য রাখায় পাঠকের পক্ষে এই আলোচনাগুলো গ্রহণে বেগ পেতে হয় না। কুরআনের আরেক বিখ্যাত তাফসীরকারক মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী রাহিমাহুল্লাহর মতে, ‘শাইখুল হিন্দ রাহিমাহুল্লাহর (কুরআন) তরজমা যদি নূর হয়, তবে মাওলানা উসমানীর তাফসীর ‘নূরুন-আলা-নূর’।’ এই তাফসীরে হাল আমলের অনেক জরুরি বিষয় নিয়েও আছে জরুরি দিকনির্দেশনা। আহলুস সুন্নাহর অবস্থান থেকে লেখা এই তাফসীরটির ভাষাগত মান উন্নত ও অত্যন্ত প্রাঞ্জল। তাফসীর পাঠের সূচনাতে এরকম একটি তাফসীরই হতে পারে কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানবার জন্য শ্রেষ্ঠ একটি মাধ্যম।
২। মাআরিফুল কুরআন (১-৮ খণ্ড)
সাম্প্রতিক কালের তাফসীরের কিতাবের একটা তালিকা করা হলে মাআরিফুল কুরআন সম্ভবত প্রথম তিনের মধ্যেই থাকবে। শাইখুত তাফসীর মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলভি রাহিমাহুল্লাহ রচিত আট খণ্ডের এই তাফসীরটি সর্বমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। নববী যুগ থেকে নিয়ে সালাফে সালেহীনের হাত ধরে উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানরা কুরআনের যে বুঝ, যে ব্যাখ্যাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিয়েছেন, এই তাফসীর সেই ব্যাখ্যাকেই তার বুকে ধারণ করেছে।
প্রায় ছয় হাজার পৃষ্ঠার এই তাফসীরখানার এই বিশাল ব্যাপ্তি দেখে সুকঠিন কোনো কিতাব বলে একে ভুল বোঝার উপায় নেই। এর অনন্যতার একটি কারণই হলো, এর ভাষারীতি সহজ এবং কুরআনের অর্থ ও মর্মের উপস্থাপনও সর্বশ্রেণীর পাঠকদের জন্য সহজ। নির্ভরযোগ্য বর্ণনার ভিত্তিতে লেখা এই তাফসীরে উঠে এসেছে আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার জবাবগুলোও। তাই কুরআনের তাফসীর করতে যেয়ে শাইখ কান্ধলভি এতে সমাবেশ ঘটিয়েছেন হাদীস, ফিকহ, তাসাওউফ, বাতিল ও ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডন সহ জ্ঞানসমুদ্রের বিশাল এক অংশ।
৩। তাফসীর ইবনে কাছীর ১ম-৮ম খণ্ড
কুরআনের তাফসীর নিয়ে পড়তে চায়, অথচ তাফসীর ইবনে কাছীরের নাম শোনেনি—এমন মানুষ অনেক কম হবার কথা। অনেক আলিমের মতে, গত সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠতম তাফসীর হচ্ছে এই তাফসীরটি। কালজয়ী মুফাসসির, মুহাদ্দিস ইমাম আবুল ফিদা ইসমাইল ইবনে কাছীর, যিনি ইবনে কাছীর নামেই সমধিক পরিচিত, তাঁর অমর কীর্তি এই তাফসীরখানা। মুসলিম অধ্যুষিত প্রতিটি দেশে, সব মাদ্রাসায়, এমনকি বহু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানেও এই তাফসীরটি জায়গা করে নিয়েছে। ইমাম ইবনে কাছীর তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার যেন মেলে ধরেছেন তাফসীরের এই কিতাবটিতে। এই তাফসীরটি এতো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে যে, বিস্তারিত তাফসীরের আলাপ এলেই এই তাফসীরটির কথা সর্বাগ্রেই চলে আসে।
কোন তাফসীর কখন পড়বেন
আমরা সংক্ষিপ্ত থেকে বিস্তারিত তাফসীরের তিনটি কিতাবের সাথে পরিচিত হলাম। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে যে, তিনটা থেকে কোনটা পড়বো। আর যদি তিনটাই ধীরেসুস্থে পড়ে ফেলার নিয়ত করে থাকি, তবে আগে কোনটা পড়বো।
এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার আগে এটা বুঝে নেওয়া দরকার যে, তাফসীরের কিতাব কিন্তু কোনো সাধারণ বইপুস্তক নয়। এগুলো কোনো গল্পের বই নয় যে, এক বৈঠকে পড়ে শেষ করে ফেলাই এর লক্ষ্য। বিষয়টি কিন্তু এরকম নয়। তাফসীর হচ্ছে কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ। অতএব, এর পাঠ হবে সময় নিয়ে, ধীরেসুস্থে। এটা সংক্ষিপ্ত, মাঝারি, বিস্তারিত সব ধরনের তাফসীরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এই মূলনীতি মাথায় রেখে আমরা প্রথমেই বাছাই করবো সংক্ষিপ্ত যেকোনো তাফসীর। স্বাভাবিকভাবেই এখানে আলোচিত তাফসীরের কিতাবগুলোর মাঝে ব্যাপ্তির দিক দিয়ে সংক্ষিপ্ত হচ্ছে তাফসীরে উসমানী। অতএব তাফসীর পাঠের সূচনাটা আপনারা করতে পারেন এই তাফসীরটি দিয়েই। এই তাফসীর তিন খণ্ডেই সমাপ্ত হয়েছে এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেও থেকেছে সীমিত। তবে প্রয়োজনের খাতিরে কিছু জায়গায় বিস্তারিত ব্যাখ্যাই আনা হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে এটি একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর। তাই যারা বিগিনার লেভেলের পাঠক, তাদের জন্য উচিত হবে প্রথমে এরকম একটি তাফসীর দিয়েই শুরু করা।
সংক্ষিপ্ত কোনো তাফসীরের আগাগোড়া পাঠ সম্পন্ন হলে এরপর এর চেয়ে কিছুটা বড়মাপের তাফসীরের দিকে আগানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এখানে বড়র মাঝে মাঝারি ব্যাপ্তির তাফসীর মাআরিফুল কুরআন-এর কথা আমরা বলতে পারি। মাআরিফুল কুরআন আকারে বড়সড় হলেও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে সাবলীল। তাই যারা ইতোমধ্যেই তাফসীর পাঠে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, তাদের জন্য এই তাফসীরটির পাঠ গ্রহণ ইনশাআল্লাহ খুব একটা কঠিন হবে না।
এখানে সবচেয়ে বড় তাফসীরের কিতাব হচ্ছে ইমাম ইবনে কাছীরের কিতাব। ইমাম ইবনে কাছীর কুরআনের বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন। তাই যারা গভীর বিশ্লেষণী ও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে আগ্রহ রাখেন, তাদের জন্যই তাফসীর ইবনে কাছীর উপযুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ। অনেকেই নাম শুনে বা অনেকের থেকে ভুলভাল সাজেশন পেয়ে শুরুতেই ইবনে কাছীর পড়তে শুরু করে দেন। এটা ভুল কাজ। প্রথমেই বড় কিতাব ধরে ফেললে অনভ্যস্ততায় আপনি সেটা ধারাবাহিকভাবে পড়ে যেতে পারবেন না। মানুষের যেকোনো কিছু শেখার স্বাভাবিক রীতিপদ্ধতিই হচ্ছে প্রথমে ছোট কিছু দিয়ে শুরু করা, তারপরে পর্যায়ক্রমে একটু একটু করে বড় বিষয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া। তাফসীর পাঠের ক্ষেত্রেই এই নিয়মটি সমানভাবে প্রযোজ্য।
আল্লাহর কালাম ভাববৈচিত্র্যে ও গভীরতায় এতো বেশি সমৃদ্ধ যে, কুরআনের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা করা কোনো মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরেও উম্মাহর মহীরুহরা আল্লাহ প্রদত্ত ইলমের মাধ্যমে তাফসীরের কিতাবগুলোতে কুরআনী মণিমুক্তোর যে সুবিশাল সম্ভার তুলে ধরেছেন, সেগুলোই আহরণ করা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি ব্যাপার। তাফসীর পাঠ আমাদেরকে নিয়ে যাবে কুরআনের গভীর থেকে গভীরে। আর যত বেশি কুরআনের গভীরে প্রবেশ আমরা করতে পারবো, ততো বেশি আমরা আল্লাহর কাছাকাছি হতে পারবো। একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় অর্জন, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে বলুন? কুরআনের তাফসীর কিন্তু আপনাকে সেই মহাপ্রাপ্তির দিকেই এগিয়ে দেবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের জন্য তাঁর পবিত্র কালামের ইলম হাসিল করাকে সহজ করে দিন। আমীন।
Leave a Reply