অনলাইন মার্কেটিং: সহজ ১০টি কৌশলে খুলে যাক সাফল্যের দুয়ার

একটা সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বাস্তব দুনিয়ার মাটিতে। সফর করে, প্রচুর খাটাখাটনি করে, হাটেঘাটে ঘাম ঝরিয়ে মানুষ ব্যবসা করেছে, মুনাফা আদায় করে নিয়েছে। সে সময় নিজের পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য মাধ্যম ছিল কম, প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ দুনিয়ায় নিজের পণ্য ছড়িয়ে দেবার কাজটি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি সোজা। শুধু প্রয়োজন কিছু কৌশলী আর সময়োপযোগী পদক্ষেপের। ব্যবসা এখনো বাস্তব জগতেই হয়, কিন্তু শুধুমাত্র অফলাইনেই এখন ব্যবসা সীমাবদ্ধ নেই। অনলাইনে মার্কেটিং এর সহজতা ও কম পরিশ্রমে প্রচুর মানুষের কাছে নিজের পণ্যকে পরিচিত করাবার যে বিরাট সুযোগ আছে, সেটা অফলাইনের ব্যবসাকে আগের চেয়ে করে দিয়েছে অনেক বেশি সহজ।

তাই অনলাইন মার্কেটিং বর্তমানের ব্যবসায়ীদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। অনলাইনে যেহেতু সহজেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে একসাথে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেই সূত্রে তাদের কাছে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রসারের সুযোগটাও থাকছে, তাই অনলাইনে মার্কেটিং করার ক্ষেত্রে কৌশলগুলো জানা ও দক্ষতার সাথে সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারাটা এই যুগের ব্যবসার জন্য খুব জরুরি একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা এমনই ১০টি সহজ; হ্যাঁ সম্মানিত উদ্যোক্তাবৃন্দ! একদম সহজ ১০টি কৌশল নিয়ে আলোচনা করবো যেগুলোর সার্থক প্রয়োগ আপনাদের অনলাইন মার্কেটিংকে এনে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের মুখ। চলুন, শুরু করা যাক।

১। স্টোরি টেলিং (Story Telling)

আমাদের সবারই একটা না একটা গল্প থাকে। প্রত্যেকটি নতুন উদ্যোগের, নতুন পদক্ষেপের পেছনে থাকে একটি কাহিনী। কোনো একটি পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করার পেছনেও আপনার রয়েছে বেশ কিছু ঘটনা, একটি বা অনেকগুলো ছোটবড় গল্প। আপনি সেই গল্পগুলো বলুন। মানুষকে জানান আপনার স্বপ্ন, চিন্তা আর উদ্যোগের কথা।

এটা প্রমাণিত সত্য যে, মানুষ গল্পের মাধ্যমে বেশি প্রভাবিত হয়। গল্পের মধ্য দিয়ে তার কাছে কোনো তথ্য পৌঁছে দেওয়া হলে সেটা তার মাথায় বেশি ভালোভাবে গেড়ে থাকে। তাই আপনার উদ্যোগ, সেই উদ্যোগকে ঘিরে আপনার চিন্তা, স্বপ্ন আর শ্রম দেবার ঘটনাগুলো গল্পের আকারে তুলে ধরুন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে। দেখবেন আপনার উদ্যোগের সাথে, আপনার পণ্য বা সেবাটির সাথে মানুষের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ খুব সহজেই গড়ে উঠেছে, যেটা কিনা আপনার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির সফল একটি প্রয়োগ।

২। কন্টেন্ট রাইটিং (Content Writing)

আপনি আপনার পণ্য বা সেবার মার্কেটিং করার জন্য অনলাইনে কোনো না কোনো একটি মাধ্যম ব্যবহার করছেন। প্রাথমিকভাবে নিজের উদ্যোগটির ব্যাপারে সবাইকে জানিয়েও দিয়েছেন গল্পের আশ্রয় নিয়ে। ব্যস, এই পর্যন্তই কি আপনার কাজ শেষ? না! বরং আপনার কাজ তো মাত্র শুরুই হলো। নিয়মিতভাবে আপনাকে লিখে যেতে হবে। লেখাগুলো কী নিয়ে হবে? আপনার কাজ নিয়ে, আপনার পণ্য নিয়ে, সেটার পরিচিতি, সেটার পারফরম্যান্স, আপনার উদ্যোগের বা প্রতিষ্ঠানের নানান বিষয় এবং এছাড়াও আরো অনেক অনেক বিষয়। এগুলো নিয়ে আপনাকে নিয়মিত লিখে যেতে হবে। একেই বলা হয়ে থাকে কন্টেন্ট রাইটিং। লেখাজোখার সাথে জুড়ে দিন সুন্দর সুন্দর সব প্রাসঙ্গিক ছবি।

এক্ষেত্রে আপনাকে কন্টেন্ট নির্বাচনে দিতে হবে সাবধানতার পরিচয়। যত ভালোভাবে কন্টেন্ট নির্বাচন করতে ও তার উপর লিখতে পারবেন, তত ভালোভাবে আপনার পণ্যের প্রচার-প্রসার বাড়তে থাকবে। মার্কেটে আপনার ব্র্যান্ডভ্যালুও পাল্লা দিয়ে বেড়েই যেতে থাকবে। মনে রাখবেন, এই কন্টেন্টগুলো হচ্ছে আপনার পটেনশিয়াল কাস্টোমারদের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। অতএব একে যথাযথভাবে ব্যবহার করুন।

৩। ভিডিও মেইকিং (Video Making)

লেখালেখির পাশাপাশি যে কাজটি আপনার কাজকে মানুষের আরো কাছে, আরো ঘনিষ্ঠভাবে পৌঁছে দিতে পারে সেটা হচ্ছে ভিডিও। যেকোনো কিছুর ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন মানুষের মনে ছাপ ফেলে বেশি। কন্টেন্ট রাইটিং এর মাধ্যমে মানুষের সাথে যে যোগাযোগের বন্ধনটা আপনি তৈরি করবেন, সেটাকে আরো শক্তিশালী করতে পারে শর্ট লেংথের ভিডিও। আপনার পণ্য বা সেবার সাথে যুক্ত যেকোনো বিষয় নিয়েই তৈরি করতে পারেন ভিডিও। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে ভিডিওর বিষয়বস্তু যাতে আপনার কাজের সাথে প্রাসঙ্গিক হয় এবং ভিডিওর দৈর্ঘ্য যেন ছোট হয়।

৪। অডিয়েন্স টার্গেট করা (Audience Targeting)

আপনি গল্প লিখলেন, নিয়মিত কন্টেন্টও লিখতে থাকলেন, সুন্দর সুন্দর সব ভিডিও-ও তৈরি করলেন। কিন্তু আপনার কাস্টোমার বেইসকে ঠিকঠাকভাবে শনাক্ত করতে না পারায় আপনার এই সব চেষ্টা আর পরিশ্রম নেহাত পানিতে চলে গেলো। এমনটা হয়। আপনার পণ্যের সম্ভাব্য ভোক্তা করা, আপনি যে জিনিসটির মার্কেটিং করতে চাচ্ছেন সেটার যথাযথ টার্গেট কারা—এই বিষয়টি যদি আপনি নিশ্চিত না থাকেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ না করেন, তবে আপনার সব পরিশ্রমই বৃথা! অতএব, আগে আপনার অডিয়েন্সকে চিনে নিন। তাদের টার্গেট করেই আপনার কন্টেন্ট তৈরি করুন। আপনার টার্গেটেড অডিয়েন্সের কাছে যাতে আপনার পণ্যের আবেদন থাকে বা সৃষ্টি হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য অডিয়েন্সের মাইন্ডসেট জানুন আর সেই অনুযায়ী নিজের কাজকে মানসম্মত করে তুলতে চেষ্টা করুন।

৫। পেইড প্রমোশন বা বুস্টিং (Paid Promotion or Boosting)

ডলারের মাধ্যমে কন্টেন্ট বুস্ট করার মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক অডিয়েন্সের কাছে আপনি ছড়িয়ে দিতে পারবেন আপনার পণ্যের কথা, যারা হয়তো সরাসরি কখনো আপনার পণ্যের সাথে পরিচিত ছিল না। সহজে বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর পদ্ধতি হিসেবে পেইড প্রমোশন খুবই কার্যকরী। তবে সঠিক অডিয়েন্স ও এরিয়া টার্গেট করে বুস্ট না করতে পারলে এই কৌশলটি মাঠে মারা যাবে। অতএব ভালোভাবে বুঝেশুনে এগোন।

৬। সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার (Social Influencer)

সোশ্যাল মিডিয়া আজকাল এমন একটি অবস্থানে চলে গেছে যে একে এড়িয়ে আপনার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি আপনি সাজাতেই পারবেন না। অগত্যা কি আর করা! সোশ্যাল মিডিয়ায় মার্কেটিং আপনার পণ্যের প্রসারে সাংঘাতিক ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে খুব কার্যকরী একটা উপায় হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী মানুষদের দিয়ে আপনার প্রোডাক্টের মার্কেটিং চালানো। কোনো একটা বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী এবং সেই বিষয়ে এক্সপার্ট অপিনিয়ন দিয়ে থাকেন, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের কাজের মাধ্যমে মানুষের কাছে খুব পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন এবং তার যেকোনো একটি কথা বা কাজ মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে—এরকম ব্যক্তিত্বকেই আমরা সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার বলে থাকি। এরকম কারো মাধ্যমে যদি আপনার প্রোডাক্টের মার্কেটিং আপনি করাতে পারেন, তবে সেটা আপনার ব্র্যান্ডভ্যালুতে যোগ করবে অনন্য এক মাত্রা। সেলসের পরিমাণে আসবে পরিবর্তন। আপনার প্রোডাক্টের প্রচার-প্রসার বেড়ে যাবে বহুগুণে।

৭। কাস্টোমার এঙ্গেইজমেন্ট (Customer Engagement)

অনলাইনে মার্কেটিং এর উদ্দেশ্য কী? নিজের প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের প্রচার ও প্রসার, এইতো? যদি সেটাই হয়ে থাকে, তবে আপনি নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে যত বেশি অডিয়েন্সকে আপনি কাস্টোমার হিসেবে পাচ্ছেন, তত বেশি লাভের খাতা ভরছে আপনার। অনেকে ফেসবুক পোস্ট বা ইনস্টাগ্রামে ছবিতে প্রচুর রিচ দেখে মনে করেন তার মার্কেটিং সফল। কিন্তু না! আপনার সফলতা লাইক/কমেন্ট পাওয়াতে নয়, আপনার সফলতা এই পটেনশিয়াল কাস্টোমারদের রিয়েল কাস্টোমার বানানোতে। তাই আপনার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকবে কাস্টোমার এঙ্গেইজমেন্ট। আপনি যত বেশি কাস্টোমার তৈরি করতে পারবেন, আপনার মার্কেটিং তত বেশি সফল বলে প্রমাণিত হবে। এজন্য আপনাকে তৈরি করতে হবে এমন সব কন্টেন্ট, যাতে করে মানুষ আপনার প্রোডাক্টের প্রতি আগ্রহী হয়। তারা এটা নিয়ে ভাবে এবং এক পর্যায়ে সেটা কেনে। এছাড়াও কাস্টোমারের সাথে আপনি কীভাবে ব্যবহার করছেন, তাদের ফিডব্যাককে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন—এগুলোও কাস্টোমার এঙ্গেইজমেন্ট বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সহায়তা করে।

৮। ইমেইল মার্কেটিং (E-mail Marketing)

মার্কেটিং এর এই তরীকাটি ব্যবসায়ীদের মধ্যে দারুণ পছন্দের। কেন জানেন? কারণ এতে করে কাস্টোমারের সাথে ওয়ান টু ওয়ান কমিউনিকেশন সম্ভব হয়ে ওঠে। ই-মেইলে আপনি একজন কাস্টোমারকে তার নাম ধরে সম্বোধন করছেন এবং তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে আপনার প্রোডাক্টের মার্কেটিং করছেন। এটা একজন কাস্টোমারের সাথে ব্যবসায়ীর সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলে। এতে করে কাস্টোমার ডিমান্ডও বুঝতে পারা যায় সহজে, যা কিনা আপনার ব্যবসাকে বড় করে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৯। ওয়েবসাইট (Webesite)

আপনার ব্যবসাটা যে ধরনেরই হোক না কেন, সেটার জন্য একটা ওয়েবসাইট খুলে ফেলাটা খুবই কার্যকর একটি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। ওয়েবসাইট এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি বিস্তৃত আকারে আপনার প্রোডাক্টের খুঁটিনাটি তুলে ধরতে পারবেন। একটা ওয়েবসাইট হচ্ছে সম্পূর্ণ আপনার নিজের একটা জগত, যেখানে আপনি আপনার পটেনশিয়াল কাস্টোমারকে দাওয়াত দিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে পারেন আপনার নিজস্ব জগত। ওয়েবসাইট কাস্টোমারদের জন্য কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়কে কমফোর্টেবল একটা জায়গায় নিয়ে যায়। তাই আপনি যখন একটি সুন্দর, ওয়েল অরিয়েন্টেড ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনার প্রোডাক্টের মার্কেটিং করবেন তখন কাস্টোমার বেইস ধরতে পারাটা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে অনেকখানি।

১০। এসইও (SEO)

এসইও বা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে ব্রাউজারে নির্দিষ্ট কিছু কিওয়ার্ড সার্চ দিলে আপনার ওয়েবসাইটটি টপ লিস্টে দেখাবে। বর্তমানে ওয়েবসাইট নির্ভর যুগে এসইও যেন অপরিহার্য হয়ে গেছে। এসইও নিশ্চিত করবে আপনি যে প্রোডাক্ট বা সার্ভিস সেল করেন, কাস্টোমার যেন সেটা খুঁজতে এসে সবার আগে আপনার সাইটকেই খুঁজে পায়। সার্চ ইঞ্জিনের রেজাল্টে আপনার সাইট যত টপে থাকবে, আপনার প্রোডাক্টের পরিচিতি ও সেলস তত বেশি বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে।

তো অনেক কথা হয়ে গেল। সহজের মধ্যে এই দশটা কৌশল আপনার অনলাইন মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজির মধ্যে রাখতে পারেন। যদি চিন্তাভাবনা করে, মার্কেটের অবস্থা বুঝে এই দশটা কৌশলের সমন্বিত প্রয়োগ ঘটাতে পারেন, তবে চমৎকার একটি রেজাল্ট পেতেও আশা করা যায় খুব একটা সময় লাগবে না ইনশাআল্লাহ। ব্যবসার ম্যাড়ম্যাড়ে দশা কাটিয়ে ওঠার পরিবর্তনটা নিজ চোখেই দেখে নিতে পারবেন তখন।

অনলাইন মার্কেটিং নিয়ে আরও জানতে, আরও শিখতে দেখতে পারেন এই প্যাকেজের বইগুলো:
ONLINE MARKETING PACKAGE

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *