মা-বাবাকে দ্বীনের দাওয়াত দেবেন যেভাবে

মা-বাবা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছেন তারা। আমরা আমাদের মা-বাবাকে তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের সমাজ বাস্তবতায় দুঃখজনক একটি সত্য হলো, আমাদের অনেক মা-বাবাই দ্বীনের অবস্থান থেকে দূরে। তারা তাদের জীবনে দ্বীনের কোনো জ্ঞান রাখেন না কিংবা রাখলেও সেটা খণ্ডিত, ভাসাভাসা এবং অপূর্ণ।

তাই দেখা যায় সন্তান যখন পরিপূর্ণ দ্বীন পালনে অগ্রসর হয়, তখন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, মা-বাবাই তার এ পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে যান। আর যদি নাও হন, তবুও সন্তানের দ্বীনদারিতায় তারা তেমন প্রভাবিত হন না। অনেক সময় দ্বীনের প্রশ্নে সন্তানের সাথে তাদের তুমুল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং এ থেকে সন্তানের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। এছাড়াও নিজের মা-বাবাকে ভুল পথে চলতে দেখে বা ভুল কাজ করতে দেখে অনেকেই তাদেরকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা চালান। সেটা কখনো সফলতার মুখ দেখে আবার কখনো দেখে না।

উপরের বিষয়গুলো বাদ দিয়েও যদি আমরা বলি, তবুও আমাদের বলতে হয় দ্বীনের দাওয়াত পাওয়ার সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বেশি হক্বদার হচ্ছে আমাদের পরিবার। আমাদের মা-বাবা যদি দ্বীন পালনের পথে প্রতিবন্ধক নাও হন, তবুও তারা আমাদের থেকে দ্বীনের দাওয়াত পাওয়ার পরিপূর্ণ হক্বদার।

দ্বীনের দাওয়াত অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় একটি কাজ। একেকজনের কাছে দাওয়াতী কাজ করতে হয় একেক পন্থায়। প্রত্যেকের মনমর্জি, জ্ঞান, রুচি, ঝোঁক, বুদ্ধিমত্তা, স্বভাব-চরিত্র ও বয়সের দিকে লক্ষ্য রেখে দাওয়াতের পথ ও কৌশল নির্ধারণ করতে হয়। আমাদের বাবা-মা যেহেতু বয়সে প্রবীণ এবং আমাদের সাথে তাদের সম্পর্কের বিশেষ একটি ধরন আছে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হলে এই বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা এখানে কিছু সাধারণ কৌশলের উল্লেখ করবো, যেগুলোর মাধ্যমে ইনশাআল্লাহ মা-বাবার কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ এবং ফলপ্রসূ হবে।

১। মা-বাবাকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিন

মা-বাবাকে সম্মানের দিক দিয়ে সন্তান হিসেবে কোনো ধরনের কমতি করবার সুযোগ নেই আমাদের। কারণ মা-বাবার মাকাম স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তাঁর পবিত্র কালামে মা-বাবার জন্য কীভাবে আচরণ করতে হবে, তাদের জন্য কোন দু’আ করতে হবে সেটা পর্যন্ত শিখিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ বিষয়েই যদি তাদের প্রতি এতোটা শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করতে হয়, তবে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার সময় এই বিষয়টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় আপনারাই ভেবে দেখুন।

২। তাদের অবস্থানুযায়ী দাওয়াত দিন

আমরা যেভাবে বুঝি, আমাদের মা-বাবাও সেভাবেই বুঝবেন এই আশা নিয়ে যেন তাদেরকে দাওয়াত দিতে না যান। কারণ এতে হীতে বিপরীতটাই হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাদেরকে দাওয়াত দিন তাদের অবস্থা বুঝে—তাদের জ্ঞান, রুচি, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে।

৩। দাওয়াত দিন সন্তান হয়ে, শিক্ষক হয়ে নয়

খুব খেয়াল রাখতে হবে, বাবা-মাকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আমাদের আচরণ যেন শিক্ষকসুলভ না হয়ে যায়। আমরা তাদের সন্তান এবং আমরা সেই অবস্থান থেকেই তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেব। তারা যাতে এটা অনুভব না করেন যে আমার সন্তান আমাকে শেখাচ্ছে বা সে আমার ওপর খবরদারি করছে। বরং ভালোবাসার সাথে, সন্তানসুলভ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাবা-মাকে শেখান, তাদের দাওয়াত দিন।

৪। সুন্দর ও নম্র ভাষায় দাওয়াত দিন

দাওয়াতের মৌলিক অবস্থানটিই হলো নম্রতা আর তা যদি হয় মা-বাবার সাথে, তাহলে তো আর কথাই নেই। এই বিষয়ে সাইয়্যিদিনা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর উদাহরণটা অনন্য, যেখানে তিনি তাঁর কাফির বাবাকে লক্ষ্য করে বলেছেন “ইয়া আবাতি”—হে আমার পিতা। “ইয়া আবাতি” এটি অত্যন্ত মায়া আর ভালোবাসা ভরে উচ্চারিত একটি ডাক। তিনি তাঁর বাবাকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছিলেন খুবই বিনম্র আর ভালোবাসাপূর্ণ শব্দের মাধ্যমে। তাঁর এই প্রীতিপূর্ণ দাওয়াতের জবাব যখন বাবা কঠোর ভাষায় দিয়েছে, তখনও তিনি তাঁর ভাষা পরিবর্তন করেননি। আমরাও এক্ষেত্রে তাঁরই অনুসরণ করবো।

৫। সবর ও হিকমাহর পথ অনুসরণ করুন

দাওয়াতের ক্ষেত্রে সবর ও হিকমাহ মৌলিক দুটি উপাদান। অতএব মা-বাবাকে দ্বীন বোঝাতে গিয়ে বা বাতিল থেকে বিরত রাখতে গিয়ে অস্থির হবেন না, ধৈর্যহারা হবেন না। কারণ এতে করে আপনি তাদের প্রতি বেয়াদবি করে বসবেন, যা আপনার নিজের এবং আপনার দাওয়াতের; উভয়টির জন্যই ক্ষতিকর। আল্লাহ কারো উপরই সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না। তাই আপনি আপনার সাধ্যানুসারে চেষ্টা করে যান। আদব বজায় রেখে, মা-বাবার আচরণে সবর করে, হিকমাহর সাথে তাদের কাছে দ্বীনের বার্তা পৌঁছে দেন।

সর্বোপরি, আল্লাহর উপরই ভরসা করুন, তাঁর কাছেই সাহায্য চান এবং ইখলাসের সাথে আমল ও দাওয়াত চালিয়ে যান। সেইসাথে উল্লিখিত কৌশলগুলো অবলম্বন করে মা-বাবাকে দাওয়াত অব্যাহত রাখুন, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আপনাকে সফল করবেন। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ।

দাওয়াহ দেবার আরও কৌশল জানতে পড়ুন:

যেভাবে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবেন
লেখক : ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী

নবিদের দাওয়াতি পদ্ধতি
লেখক : শাইখ টিম হাম্বল

আল্লাহর পথে দা’ওয়াত
লেখক : ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

দাওয়াহ ও হিকমাহ
লেখক : রিফায়ি সুরুর

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *