বালক ইমাম মালেকের ঈদ-আনন্দ

ছোটবেলায় ঈদের দিন মানেই ছিল শুধু আনন্দ। এইদিন কোনো বই পড়া হবে না। মা-বাবা কেউই এইদিন পড়াশোনা নিয়ে জোরাজোরি করবে না। মজার বিষয় হচ্ছে, হাজার বছর আগেও এই চল ছিল। শিশুরা ঈদ পেলেই আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে উঠত। সকালে নতুন জামা পরে, সুগন্ধি লাগিয়ে মাসজিদে যাওয়া, বাড়িতে ফিরে এসে খোশগল্পে মত্ত হওয়া, ভালো কিছু খাওয়া, এভাবেই কাটত তাদের ঈদের দিন। সেদিন কোনো দরসে বসা হবে না, কোনো লেখাপড়াও নয়। কিন্তু শিশুকালে ইমাম মালেক ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া।

ইমাম ইবনু শিহাব আয-যুহরি ছিলেন ইমাম মালেকের একজন হাদীস-শিক্ষক। আয-যুহরির ক্লাসে সব সময় ভিড় লেগে থাকত। ইমাম মালেক উনাকে একা পেতেন না। একদিন একটি বুদ্ধি খাটালেন তিনি। ঈদের দিনে তিনি তাঁর শিক্ষক ইমাম আয-যুহরির বাসায় যান।

চলুন, ঘটনাটা তাঁর মুখেই শুনি। তিনি বলেন:

‘ঈদের দিন সালাতে উপস্থিত হয়ে ভাবলাম, আজকের এই দিনে নিশ্চয়ই কেউ ইমাম ইবনু শিহাবের দরসে যাবে না। তাই সালাতের পরপরই চলে গেলাম তাঁর বাড়ি। গিয়ে দরজায় টোকা না দিয়ে বাড়ির সামনে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।’

সেসময় একটি চল ছিল, ‘শাইখের দরজায় টোকা দেয়া যাবে না।’ অর্থাৎ শিক্ষকের কাছে গিয়ে সরাসরি তাঁর দরজায় কড়া নাড়া বেয়াদবি। শিক্ষককে ডেকে বাইরে আনা যাবে না। তিনি নিজের সময়মতো বেরিয়ে এসে ইলম বিতরণ শুরু করবেন। বর্তমানে এরকম আদব-চর্চা একদম হারিয়ে গেছে বললেই চলে। বিজ্ঞ কোনো আলেম পেলেই আমরা এখন প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন ছুড়ে দিতে থাকি। ফেসবুক হলে তো কথাই নেই, ম্যাসেজে গল্পগুজব জুড়ে দিই। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরিদের যুগটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা যেমন ইলমের কদর বুঝতেন, তেমনি আলিমের কদরও বুঝতেন।

যাইহোক, ইমাম মালেকের কথায় ফিরে যাই। তিনি তাঁর শিক্ষকের বাসার বাহিরে বসে অপেক্ষা করছেন। বললেন, ‘আমি শুনতে পেলাম ইমাম ইবনু শিহাব তার দাসীকে বলছেন, “বাইরে কে এসেছে, দেখো তো।” বলা হলো, “মালেক ইবনু আনাস এসেছে।” এরপর ইমাম আয যুহরি দাসীকে পাঠিয়ে আমাকে ভেতরে ডেকে নিলেন। বললেন, “তোমাকে তো সালাতের পর বাড়ি যেতে দেখলাম না। খাওয়া দাওয়া করেছ?”

— “জি না, খাইনি।”
তিনি আমার জন্য খাবার আনালে আমি বললাম, “আমি তো এখানে খেতে আসিনি।”
— “তা হলে?”
— “আমাকে হাদীস বর্ণনা করে শোনান।”
— “ঠিক আছে, এসো।”

স্লেট বের করলাম আমি। এরপর ইমাম ইবনু শিহাব আমাকে চল্লিশটি হাদীস সনদ সহকারে শেখালেন। শেষ হওয়ার পর বললাম, “আরও কিছু হাদীস বলুন।”

তিনি আমাকে বললেন, “যদি এই চল্লিশটি হাদীস স্মরণে রাখতে পারো, তা হলে তুমি হাফিজুল হাদীস।” আমি বললাম যে, “আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।” ইবনু শিহাব আমার হাত থেকে স্লেট নিয়ে বললেন, “দেখি, শোনাও তো।” সবগুলো হাদীস মুখস্থ শোনালাম আমি। এরপর তিনি আমার স্লেট ফিরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, “ওঠো, তুমি একজন জ্ঞানপাত্র।”

বালক ইমাম মালেকের জন্য ঈদের সেদিনটা ছিল সেরা দিন। কারণ, তিনি নতুন ৪০টি হাদীস শিখতে পেরেছেন। তাও আবার এমন একজনের কাছ থেকে, যাকে সারাবছর একাকী পাওয়া অসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু ইমাম ইবনু শিহাবের জন্য সেটি ছিল এক আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতা।

ঈদের দিন সবাই যেখানে আনন্দ করছে, নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরছে, ভালো ভালো খাবার খাচ্ছে, সেখানে এই অল্পবয়সী ছেলেটি তাঁর কাছে এসেছে হাদীস শেখার জন্য। ঈদের সালাত আদায় করে বাড়িতেও যায়নি, খাবার দিলেও খায়নি। ৪০টি হাদীস, তাও আবার প্রতিটি হাদীসের সাথে বর্ণনাকারীদের নাম, সব মিলিয়ে এত বড় লেখা দেবার পরেও ইমাম মালিক সেটা এক দেখায় মুখস্ত করে ফেলেছেন! সত্যি, অবাক হবার মতই।

উম্মাহর কিংবদন্তিরা‘ বই অবলম্বনে।

Add Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *