দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানোর নেশা বাঙালির রক্তে। নতুন নতুন দেশ, নতুন নতুন মানুষ দেখার যে আনন্দ, সেটা আসলে একবার পেয়ে বসলে এ থেকে দূরে থাকা মুশকিল। সেই বহুকাল আগে থেকেই বাঙালির এই ভ্রমণ নেশা রীতিমতো তুঙ্গে! আগেকার গল্প-উপন্যাসগুলো খুলে দেখুন। ‘হাওয়া বদল’ কথাটা প্রায়ই সেসবে খুঁজে পাবেন আপনারা। বাঙালির পকেটের জোর থাকুক বা না থাকুক, ঘুরতে সে ভালোবাসে ভীষণ। আজও এদেশের মানুষের মধ্যে এই ঘুরতে যাবার প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় বিদ্যমান।
তাছাড়া, এই ভ্রমণপ্রিয়তার জন্যেই এদেশে ভ্রমণ সাহিত্য ব্যাপক আকারে জনপ্রিয়। নিজে ঘুরতে না যেতে পারার আক্ষেপটা আমরা বাঙালিরা পুষিয়ে নেই বই পড়ে, এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো!
ভ্রমণ আমাদের কাছে জনপ্রিয় হবার আরো একটি কারণ হিসেবে বলা যায় আড্ডার প্রতি আমাদের ভালোবাসা। আড্ডাপ্রিয় জাতি হিসেবে ভালোই পরিচিত আমরা। ভ্রমণ মানেই নতুন নতুন আড্ডা জমানো নয়তো আড্ডায় নতুন নতুন বিষয়ের খোরাক যোগানো। ঘুরতে বেরোলে দেশ চেনা হয়, নতুন সব মানুষ চেনা হয়, চেখে দেখার সুযোগ হয় নতুন নতুন আর নানা স্বাদের বিচিত্র সব খাবার। খুব কাছ থেকে দেখা যায় একেক জায়গার মানুষকে, তাদের জীবন আর সংস্কৃতিকে।
ভ্রমণ সাহিত্যের কথা বলছিলাম। সাহিত্যের এই ধারাটি আমাদের দেশ খুব জনপ্রিয়। ঘুরতে বেরোলে শরীর মন চনমনে হয়ে ওঠে। ঘুরতে বেরোনোর গল্পগুলোও সেই চনমনে ভাবের রেণু চারপাশে ছড়িয়ে দেয়। পড়তে বসলে মনে হয় নিজেও বুঝি লেখকের সাথে ঘুরে এলাম। আজ আমরা এইখানে এরকম ছয়টি বইয়ের সাথে আপনাদের পরিচিত করিয়ে দিতে এলাম। দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ানোর ফুরফুরে ভাবের রেণুতে সমৃদ্ধ একেকটা বই। চলুন, দেখে ফেলা যাক বইগুলোর নামধাম আর হালকা পাতলা পরিচয়।
জেরুসালেম। নামটি শুনলেই যেন সহস্র বর্ষের ইতিহাস সব একসাথে বড় বড় হয়ে ফুটে ওঠে। কতকালের, কতশত সহস্র ইতিহাসের জন্ম এই ভূমিতে! কত মহাপুরুষ এসেছেন এই ভূমিতে, কত নবী-রাসূলের পবিত্র ছোঁয়ায় ধন্য হয়েছে এই ভূমি। কত যুদ্ধ, কত সংঘাত এই ভূমির মালিকানা নিয়ে, সে তো আজও আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। এই যুদ্ধ চলমান, সেই কবেকার সময় থেকেই। বুলবুল সারওয়ারের লেখা এমনিতেই মনোমুগ্ধকর, লেখার জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রাখেন আগাগোড়া। আল-আক্বসার পবিত্র ভূমিতে তার বিমুগ্ধ হৃদয়ের কথাগুলো পাঠককে চুম্বকের মতো টেনে রাখবে বইটির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত।
প্রাচীন সভ্যতার ও এককালের পারস্য সাম্রাজ্যের চিহ্নকে এখনো ধারণ করে আছে যে দেশটি, তার নাম ইরান। “ইরানি দাস্তান” ইরানের সভ্যতা-সংস্কৃতিরই বিস্তারিত এক উপাখ্যান। দীর্ঘদিন ইরানে কাজ করার সুবাদে লেখক মিশে যেতে পেরেছেন ইরানিদের সাথে, খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে ইরানের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর যাপিত জীবনের নানান খুঁটিনাটিকে।
এ গল্প ভূস্বর্গের। এ গল্প এক নয়নাভিরাম, সুন্দরে ঠাসা দেশের, যেখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য তার পানে চেয়ে থাকা চোখে নামায় মুগ্ধতার আবির। কাশ্মীর—প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভূমিগুলোর একটি হয়েও তার সর্বাঙ্গে মেখে আছে দুঃখ-দুর্দশা আর লাঞ্ছনার কষ্ট। এ এক অদ্ভুত মিশেল, প্রকৃতির সাথে যন্ত্রণাময় বাস্তবতার। ঝিলাম নদীর শান্ত স্রোতের পাশে বয়ে চলা কাশ্মীরের প্রকৃতি আর জীবন প্রাণ পেয়েছে এই বইটির ভাষায়। আরো একটি বুলবুল সারওয়ার স্পেশাল, চুম্বকের মতো টেনে রাখা এক ভ্রমণকাহিনী।
পাকিস্তান আমলে লেখকের বিলেত বা লন্ডন যাত্রার এক মহাকাব্যিক বিবরণ দিয়ে শুরু এই বইটি। প্রথম দু’চার পাতার সাবলীল বর্ণনাতেই যে বইটির মধ্যে আপনি একেবারে মজে যাবেন, সে নিশ্চিত করেই বলা যায়। ভ্রমণকাহিনী মানে দেখবার মতো একজোড়া চোখ আর মুহাম্মদ আবদুল হাই ঠিক এরকমই একজোড়া চোখের মানুষ। ভ্রমণসাহিত্যে ইতিমধ্যেই একটা ক্লাসিকের জায়গায় চলে গিয়েছে “বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন”। ভ্রমণ, ইতিহাস আর মানুষকে একসাথে কোনো বইয়ে পড়তে যদি চান, তবে এই বইটিই।
ইতিহাস তার কয়েক স্তরের সব ঘটন-অঘটন নিয়ে যেন জমাট হয়ে আছে ভারতের বুকে। তাই ভারতে ঘুরতে যাওয়া মানে বরাবরই বিশেষ কিছু। অধ্যাপক শাহ মোস্তফা খালেদের লেখনীর মুনশিয়ানাতে ভারত সফরের এই পুরো বর্ণনাটি হয়ে উঠেছে সাধারণ কোনো ভ্রমণকাহিনীর চেয়ে বিশেষ কিছু। ইতিহাসের বিভিন্ন পীঠস্থানে হাজিরা দেবার বর্ণনা তিনি যে নান্দনিক আর সরস সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন, তাতে পাঠকের মনে হতেই পারে যে তিনি নিজেও সে যাত্রায় লেখকের সঙ্গেই ছিলেন!
সূর্যোদয়ের দেশ বললেই মানুষ চিনে যায় জাপানকে। জাপানের মানুষের অদম্য মনোভাব আর তাদের কঠোর পরিশ্রম এশিয়ার মধ্যে তাদেরকে আলাদা এক মর্যাদা এনে দিয়েছে। জাপানে পড়তে কিংবা কাজে কত মানুষই তো যান। কিন্তু জাপানের খুঁটিনাটির খবর রাখেন তাদের ক’জন? তবে “জাপান কাহিনি”র লেখক যে অনেক খবর রাখেন, সেটা কিন্তু একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়। নইলে কি আর ৮ খণ্ডের ভ্রমণকাহিনী লেখা যায়, বলুন? জাপান নিয়ে আদি থেকে অন্তে যেতে চাইলে এই বইগুলোই আপনার সেরা বাহন। প্রতিটি বইই আকারে ছোট, এক বসাতেই পড়ে ফেলবার মতো।
তো আজকে এই পর্যন্তই। ভ্রমণসাহিত্য পড়ুন আর বইয়ের পাতাতেই নিন উন্মুক্ত বিশ্বের স্বাদ।
Leave a Reply