জীবনের পথে চলতে চলতে মাঝে মধ্যেই আমাদের মাল্টিকালার জীবনটা যেন একদম ডিসকালার হয়ে যায়। আমরা ভেঙে পড়ি, থমকে দাঁড়াই। ঠিক যেন প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে নুইয়ে পড়া নরম দেহের কোনো তরুলতা কিংবা চলতে চলতে হুট করে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো গোমড়ামুখো দেয়াল।
জীবন আমাদের এরকম অনেক খেলাই দেখায়। অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী হই আমরা। জীবনের সমুদ্রে কখনো জোয়ার আসে, তো কখনো আসে ভাটা। এভাবেই চলতে থাকে আর চলবেও। কোনো কিছু বা কাউকে না পাওয়ার দুঃখ, হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা, বিচ্ছেদের যাতনা কিংবা হয়তো খুব ছোট কিছু—এগুলো আমাদের অনেককেই একদম ভেঙে ফেলে, বিপর্যস্ত করে দেয়। আমরা ভেঙে পড়ি, মুষড়ে পড়ি চরম বেদনায়। বিপদ, দুঃখকষ্ট এগুলো মানুষের জীবনেরই অংশ। হ্যাঁ, অবশ্যই এগুলো আমরা চাই না, কিন্তু তাই বলে এগুলো ছাড়াও জীবন কারোরই থাকে না। এই পৃথিবীতে আদিকালে কিংবা এই কালে, এমন কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জীবনে কখনোই কোনো দুঃখকষ্ট আসেনি, যে কখনোই কোনো বিপদের মুখোমুখি হয়নি। এমন একটা মানুষও নেই!
চলুন, একটু প্রকৃতিতে ঘুরে আসি। চোখ বন্ধ করুন, খুলে দিন মনের জানালা। আপনাকে একটা দৃশ্য দেখাই। কোনো এক ঝড়ের রাত। শোঁ শোঁ করে প্রচণ্ড বেগে ঝড় তুলে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বাতাসের শোঁ শোঁ’র সাথে সাই সাই করে উড়ছে সবকিছু। নরম কাণ্ডের উপর দাঁড়ানো একটি গাছ ঝড়ের তাণ্ডবে প্রায় বেঁকে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর আর চাপ সামলাতে না পেরে মট করে ভেঙেই গেল বেচারা।
এই নরম, দুর্বল গাছটার অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি গাছ। শক্ত, সবল তার দেহ। এই ঝড়ের মধ্যেও ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। ঝড়ের দাপটে সেও আহত, কিন্তু বিধ্বস্ত নয়। বাতাসের প্রবল ঝাপটাকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখছে সে ভালোভাবেই।
প্রিয় পাঠক! এই গাছটির মতো হন। ওই গাছের মত হবেন না যে কিনা বাতাসের ঝাপটার সামনে সহজেই নতজানু হয়ে যায়, সহজেই ভেঙে যায়। কখনো ভেঙে পড়া যাবে না। হ্যাঁ, নিজেকে ধরে রাখা, নিজেকে টিকিয়ে রাখা কঠিন। কখনো কখনো সেটা বেশ কঠিন। আমরা মানছি এই সত্য। কিন্তু আসুন না একবার ভাবি আরো ক’টা কথা!
বিপদটা যখন এলো, যখন কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হলেন তখন একবার ভেবে দেখুন তো এই বিপদ আপনাকে আল্লাহর কাছে, তাঁর আনুগত্য আর ভালোবাসার কাছে নিয়ে যাচ্ছে কি না? যদি যায়, যদি এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে আপনার কোনো চিন্তা নেই। এই বিপদ আপনার জন্য বড় কোনো সুসংবাদের বার্তা নিয়ে এসেছে। হয় এই বিপদে আল্লাহ আপনাকে পরিশুদ্ধ করে দেবেন, আপনাকে আগের চেয়েও বেশি মর্যাদাবান করে তুলবেন, আপনার রিযক বাড়িয়ে দেবেন, আপনাকে আগের চেয়েও বেশি তাঁর কাছে টেনে নেবেন। কিন্তু উত্তরটা যদি না হয়, তখনই কিন্তু সকল টেনশন! অতএব, এই উত্তর যাতে কখনোই যাতে হ্যাঁ ছাড়া অন্যকিছু না হয়।
ভেঙে পড়ার কিচ্ছু নেই, বুঝলেন তো? এখনো যদি মনটা খারাপ হয়ে থাকে, যদি অন্তরটা ব্যথায়, কষ্টে মুষড়ে থাকে তাহলে আসুন, আরেকটু গল্প করি আপনার সাথে। সুসংবাদ গ্রহণ করুন, প্রিয় পাঠক!
মনে রাখবেন, বিপদ-আপদ গুনাহের মাফের সুযোগ
ছোটবড় বিপদ বা বড়সড় বিপদ যেটাই হোক না কেন, তার মাধ্যমে আল্লাহ আপনাকে গুনাহ থেকে ফ্রি করে দিচ্ছেন। আপনি আযাদ হয়ে যাচ্ছেন, মুক্তস্বাধীন বিহঙ্গের মতো শৃঙ্খলহীন হয়ে যাচ্ছেন। গুনাহর মহা বিপর্যয় আর বিপদকে আল্লাহ জ্বালিয়ে দিচ্ছেন বিপদের মাধ্যমে, যেটা হয়তোবা কারণ হতো কঠিন আগুনের উত্তাপের!
দুঃখ-কষ্ট: আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালোবাসা
আল্লাহ তো আপনাকে ভালোবাসেন। মা যখন তার আদরের সন্তানটাকে পিট্টি দেন, সেটা কি তার সাথে দুশমনি করে দেন? নাকি তাকে মেরে ফেলার জন্য দেন? মা বরং আদরই করেন বেশি, মারেন অনেক কম। পিট্টি দিয়ে তার মায়ার সন্তানটাকে মা চান শুধরে নিতে, তার কল্যাণ করতে। অতুলনীয় ভালোবাসার অধিকারী যে সত্তা আপনাকে নিজের হাতে সৃষ্টি করলেন, আপনার জন্য তাঁর ভালোবাসার পরিমাণ কি কল্পনাও করতে পারবেন? আপনি কেন ভেঙে পড়বেন যেখানে তিনি আপনাকে কখনোই ছেড়ে যাননি আর যাবেনও না? কবরের একলা সময়টাতেও তো তিনি তাঁর মায়ার বান্দাগুলোকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যাবেন না। কীসের ভয় আপনার? কেনই বা কষ্ট পাচ্ছেন আপনি?
বিপদ যখন নেয়ামত
আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন তিনি আপনাকে একটু “নেড়েচেড়ে” দেখবেন। কী দিয়ে? কিছুটা ভয় দিয়ে, কিছুটা ক্ষতি দিয়ে, কিছুটা বিপদ দিয়ে। তারপর কি বলেছেন জানেন? যারা এগুলোতে সবর করবে, তাদের জন্য তিনি দিয়ে রেখেছেন মহা সুসংবাদ। বুঝতে পারছেন কিছু? কিছু কি নাড়া দিচ্ছে ভেতরে? যে সে কেউ নয়, সাত আসমান আর সাত যমীনের মালিক আপনাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন, যদি তাঁর ভরসায় থেকে সবর করে যেতে পারেন। আপনি কেন হতাশ হবেন ভাই? ইন্নাল্লাহা মা’আস সাবিরীন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। কনফার্মড!
নবীজির জীবনী থেকে অনুপ্রেরণা নিন
কষ্টে, দুঃখে মনটা যদি না মানে, যদি বুক ভেঙে আসতে চায় তবে একবার, মাত্র একটিবার ভেবে দেখবেন আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা। তাঁর মতো বিপদ আর পরীক্ষার মুখোমুখি আর কেউ হয়নি আর হবেও না—এটা স্বয়ং তাঁর কথা। তিনি কি ভেঙে পড়েছিলেন? তায়েফে পাথরবৃষ্টিতে রক্তে-ঘামে-অশ্রুতে চোখের সামনে মৃত্যুর ছায়া ঝুলে থাকা অবস্থায়ও কি তিনি ভেঙে পড়েছিলেন? না, বরং অশ্রুসিক্ত নয়নে হাত তুলেছিলেন মালিকের দরবারে—মালিক তুমি যদি আমার হও, তবে আমি আর কিছুরই পরওয়া করি না! সেই নবীর উম্মত হয়ে আপনি আমি ভেঙে পড়বো, এ-ও কি হয়? বিলকুল নেহি! দুঃখ আর বেদনার যত বড় ঢেউই আসুক না কেন, মাথার উপর আসমান ভেঙে পড়ুক না কেন, কুছ পরওয়া নেহি যদি আল্লাহ আমাদের সাথে থাকেন। কোনোকিছুই একজন মুমিনের হতাশ হওয়ার জন্য, ভেঙে পড়ার জন্য যথেষ্ট নয়, হতে পারে না।
তাই প্রিয় পাঠক! এই সফর একদিন শেষ হবে, এই যন্ত্রণারও একদিন অবসান ঘটবে। অতএব আপনি ভেঙে পড়বেন না। সুবহে সাদিকের সোনাঝরা সময়গুলো আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে, আপনি সেটা নিশ্চিত থাকুন। আল্লাহকে আঁকড়ে ধরুন, তাঁর উপরই ভরসা করুন, তাঁর কাছেই সাহায্য চান আর অবশ্যই তাঁর জন্যই বেঁচে থাকুন। আপনার জন্য ভালোবাসা রইলো।
দুঃখ-কষ্টের সময়ে আরও অনুপ্রেরণা পেতে যে বইগুলো আপনাকে সহায়তা করবে:
বিপদ যখন নিয়ামাত (২)
লেখক : ড. ইয়াদ কুনাইবী
দুশ্চিন্তাকে দিই ছুট্টি
লেখক : মুহাম্মাদ ইফাত মান্নান
দুঃখ-কষ্টের হিকমত
লেখক : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ, ইমান ইযযুদ্দিন আবদুস সালাম
হতাশা শব্দটি আপনার জন্য নয়
লেখক : শাইখ ড. মাশআল আব্দুল আযিয আল-ফাল্লাহি
রিল্যাক্স অ্যান্ড হ্যাপি
লেখক : শাইখ মুহাম্মাদ আল গাজালী
Leave a Reply