দেনা মৃত্যুর চেয়ে খারাপ

আমার জীবনে সবচেয়ে দুঃসহ মুহূর্ত ছিল, যখন আমি এক্সিডেন্ট করি। বয়স তখন আমার ২০ এর আশেপাশে। এক মাতাল ড্রাইভারের কারণে এক্সিডেন্টটা হয়। আমি মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাই। অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে, মনে হয়েছিল আমি মারাই যাবো। খুব হতাশায় ডুবে গিয়েছিলাম। কিন্তু এর অনেক পরে আমি যখন দ্বিতীয়বারের মতো হতাশায় ডুবে গেলাম, এটা ছিল আমার জন্য গাড়ি দুর্ঘটনার চাইতেও মারাত্মক।

২০০৮ সালের কথা। সেই ১৯৩০ সালের মন্দার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ২০০৮ সালে চরম মন্দা চলছিল। ফলে গাড়ি দুর্ঘটনার পরের বছরগুলোতে আমি নিজেকে অনেক এগিয়ে নিলেও ২০০৮ সালে এসে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ি। রাতারাতি সফল হবার যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেটা আর কাজ করছিল না। বিলের পর বিল জমে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই পরিশোধের। এই দিকে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আমার প্রথম সন্তান নেবার কথাও ভাবছিলাম। কিন্তু আমি ডুবে গেলাম দেনায়। প্রায় সবকিছুই বন্ধক রাখতে হলো। মনে হচ্ছিল এর চাইতে হতাশার আর কিছু হতে পারে না।

আপনি যদি আমাকে এখন জিজ্ঞেস করেন, আমার জীবনে সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত কোনটা ছিল, গাড়ি দুর্ঘটনা নাকি আর্থিক সংগ্রাম, তাহলে আমি আর্থিক সংগ্রামের কথাই বলব। মাতাল ড্রাইভারের কারণে মাথায় আঘাত পাওয়া, ১১টি হাড় ভেঙ্গে যাওয়া, জীবনভোর মাথায় ব্যথা নিয়ে চলা, ছয় মিনিট মৃত্যের মতো পরে থাকা, জ্ঞান ফেরার পর শোনা—আমি হয়ত আর কখনই হাঁটতে পারব না—অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ মনে করবে, এসবের চাইতে খারাপ কিছু আর ঘটতে পারে না কারও সাথে। কিন্তু না, বিষয়টা আসলে এত কঠিনও না।

কেন জানেন? আমি যখন এক্সিডেন্ট করি, আমার সেবা করার জণ্য অনেক মানুষ ছিল। হাসপাতালে আমার পরিবারের কেউ না কেউ সারাক্ষণ আমার পাশে থাকত। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি—সবাই ছিল আমাকে ঘিরে। ভুলব না সেসব ডাক্তার ও নার্সদের কথাও, যারা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের আন্তরিক। মোটকথা হাসপাতালের জীবনটা ছিল সহজ। আমার ওপর কোনো ভার ছিল না।

কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনার সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা তৈরি হয়। অর্থাৎ আমি যখন প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন। সে-সময় কেউ আমাকে সহানুভূতি জানাতে আসেনি। খোঁজ নেয়নি কীভাবে বেঁচে আছি। খাবার দাবার নিয়ে আসা, দেখতে আসা, এসব কল্পনাও করা যায়নি তখন। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ সমস্যা নিয়ে। পুরো জীবনটা নিয়েই আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে নিজেকে একজন বন্দীর মতো মনে হচ্ছিল।

একদিন আমাকে ভয় ও অনিশ্চয়তা পেয়ে বসল। শুধু বিছানায় শুয়ে থাকাটাই হয়ে গেল আমার স্বস্তি লাভের একমাত্র মাধ্যম। আত্মহত্যার কথা প্রতিদিনই ভাবতাম। কোথাও সমাধান পাচ্ছিলাম না, যদিও জানি অবশ্যই এই সঙ্কট থেকে বের হবার রাস্তা আছে। এভাবেই চলে গেল অনেকগুলো দিন, মাস…

তারপর এক সকালে কী থেকে কী হলো, আমার জীবনের মোড়ই ঘুরে গেল ১৮০ ডিগ্রি এ্যাঙ্গেলে….

সেদিন সকালেও খুব হতাশা নিয়ে ঘুম থেকে উঠি। আসলে পুরো সপ্তাহটাই ছিল হতাশার। কিন্তু ঐ সকালে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করে ফেললাম। আমি আমার এক বন্ধুর পরামর্শে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম দৌঁড়াতে। উদ্দেশ্য, দৌঁড়ে মাথাটা হালকা করতে হবে। বন্ধু বলেছিল, যখন সে খুব চাপ অনুভব করত, তখন সে দৌঁড়াতো। কারণ, এটা তার চিন্তার দ্বার খুলে দিতো। ভিতরকার তেজ বাড়িয়ে দিত এবং বর্তমান সমস্যা থেকে বের হতে সহযোগিতা করত।

তাই আমিও দৌঁড়ানোর কথা ভাবলাম। বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে বের হয়ে পড়লাম, যে বাড়িটা কিছুদিনের মধ্যে ব্যাংকের কব্জায় চলে যাবে। কানে হেডফোনে লাগানো ছিল আমার। শুনছিলাম একটি আত্ন-উন্নয়মূলক অডিও লেকচার। অডিওটা যদিও আগে শোনা ছিল, কিন্তু সত্য কথা হলো, আমি এতদিন অনুধাবন ক্রতে পারিনি। আসলে আমাদের জীবনে কখনও কখনও কোনো কিছু বার বার শোনা সত্ত্বেও জীবনে কোনো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু এভাবে শোনা চালিয়ে গেলে একদিন সেটা আপনার মনের স্ক্রিনে ক্লিক করবেই।

সেই সকালে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল আমার সাথে। লেকচারে শুনছিলাম বক্তা বলছেন, অনেকটা এরকম কথা: ‘আপনি জীবনে তখনি উন্নতি করতে পারবেন যখন আপনি নিজের সার্বিক বিষয় উন্নত করবেন। কারণ, সফলতা সবসময় আপনার নিজের উন্নয়নের/আত্মউন্নয়নের উপর নির্ভর করে।’

এই কথাটাই আমাকে জাগিয়ে তুলল। এটা ছিল আমার হতাশার রাজ্যে আসা একটা জোয়ারের মতো। এক বাস্তবতার জোয়ার।

কীভাবে হ্যাল এলরড দেনা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, তার জীবন পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তগুলো জানতে পড়ুন:
‘দ্য মিরাকল মর্নিং’


by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *