(১) শোকর আদায়
রমাদানের প্রতিটি মুহূর্তই দামী, প্রতিটি মুহূর্তেই রহমত বর্ষণ হয়। এর ভিতর সবচেয়ে বেশি দামী এবং রহমত থাকে রমাদানের শেষ দশকে। রব্বুল আলামীন রমাদানের শেষ দশ দিনকে সব থেকে উত্তম দিন বানিয়েছেন। কাজেই তাঁর শোকর শোকর আদায় করুন, যিনি অল্প আমল করেও হাজার মাসের সাওয়াবের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নেয়ামতের শোকর আদায় নেয়ামতের মূল্য বুঝতে শেখায়। অতএব এই শেষ দশদিন হলো এমন কিছু সময়, যখন নিজের আত্মার সমৃদ্ধি এবং পরিচর্যার জন্য বেশি জোর দিতে হবে।
(২) কোমর বেঁধে নামুন
সহীহ বুখারীতে আছে, আয়েশা (রাযি.) বলেন, “রমাদানের শেষ দশদিন শুরু হবার সাথে সাথে নবীজি (ﷺ) কোমর বেঁধে ইবাদতে নেমে পড়তেন এবং উনার নিজের পরিবারবর্গকেও সারারাত জেগে ইবাদত করতে বলতেন।”
সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, ‘কোমর বেঁধে নেমে পড়া কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হলো, রমাদানের শেষ দশদিন স্ত্রীদের সাথে নবীজির কোনো সম্পর্ক থাকত না।’ আসলে শেষ দশদিন তিনি ইবাদতে এতটাই মশগুল থাকতেন যে, উনার স্ত্রীদের কাছে যাবার সময়টুকু পেতেন না।
নবীজির অতীত বর্তমান সকল গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। তথাপি শেষ দশদিন এতটাই ইবাদতে মশগুল হতেন! এই দিকে আমরা জানি না, আমাদের কোন গুনাহগুলো আল্লাহ মাফ করেছেন, তাহলে আমাদের কতটা ইবাদত করা উচিত?
(৩) দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন
রমাদানের প্রথম বিশ দিন পরিবারের সাথে বৈধ সম্পর্ক রাখলেও শেষ দশদিন নবীজি পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন। বিষয়টা এ জন্য নয় যে, এগুলো হারাম। বরং এই দশ দিনকে তিনি আল্লাহর সাথে একান্ত কাটানোর জন্য নির্ধারণ করতেন। দুনিয়ায় বসে আরশে আযীমের মালিকের সাথে সময় কাটাতেন। অতএব জাগতিক যত সম্পর্ক, মনোযোগ ব্যাঘাতকারী যত বিষয় আছে, সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে আল্লাহর জন্য বাজেট করুন। মোবাইল ফ্লাইট মুডে রেখে দিন; পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সবাইকে দশ দিনের জন্য বিদায় জানিয়ে নিজেকে রবের সমীপে বিলিয়ে দিন।
(৪) ইবাদতে বৈচিত্র্য আনুন
ইবনু রজব (রহ.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূল (ﷺ) শেষ দশদিন এমনভাবে ইবাদতে মশগুল থাকতেন, যা তিনি বছরের অন্য কোনো সময় থাকতেন না। শেষ দশদিন তিনি রাত জেগে সালাত আদায় করতেন, যিকিরে ব্যস্ত থাকতেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করতেন।
কাজেই আপনিও ইবাদতে বৈচিত্র্য আনুন। শরীয়ত সম্মত আপনার পছন্দসই যে কোনো আমল বেছে নিন, যে আমল আপনাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে। কারও ক্ষেত্রে সালাত, কারও ক্ষেত্রে যিকির, কারও ক্ষেত্রে কুরআন, বিভিন্ন জন বিভিন্ন ইবাদত দ্বারা আল্লাহকে অধিক কাছে অনুভব করেন। অতএব আপনার পছন্দের ইবাদতটি খুঁজে বের করুন এবং সেটি বেশি বেশি করুন। বৈচিত্র্য আনুন।
(৫) ভুলে যাওয়া সুন্নাহ: ইতিকাফ
মানুষ যাকে যত বেশি ভালোবাসে, তার সাথে একান্তে সময় কাটাতে ততই পছন্দ করে, প্রশান্তি পায়। তদ্রূপ বান্দা যত বেশি তার রবকে জানে, তাঁর সাথে একান্তে সময় কাটাতে ততই প্রশান্তি অনুভব করে, আনন্দিত হয়। আর ইতিকাফই সেই আমল, যা দুনিয়াবি সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপনের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়।
.
আবু হুরাইরা এবং আয়েশা (রাযি.) সহ আরও অনেকে বর্ণনা করেন, নবীজি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি বছর ইতিকাফ করেছেন। ইবনু মুনযির এবং শিহাব বলেন, ‘এটা খুবই বিস্ময়কর, মুসলিমরা ইতিকাফ ত্যাগ করেছে অথচ নবীজি (ﷺ) মদীনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনও ইতিকাফ ত্যাগ করেন নি।’
(৬) রবের দুয়ারে নিবিড় মনে
ইতিকাফে ব্যক্তি তার পরিবার, ব্যবসা বাণিজ্য, দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আসে। কাজেই ইতিকাফে বসে আড্ডায় জড়ানো, মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা, এসব মোটেও উচিত নয়। ইমাম আহমাদ (রহ.) বিশেষভাবে বলেছেন, ‘(ইতিকাফে) মুমিনদের উচিত লোকদের সাথে মিশ্রিত হওয়া থেকে দূরে থাকা। এমনকি দ্বীনের শিক্ষা কিংবা নসিহত দেওয়ার মতো ব্যাপার হলেও তাতে জড়ানো যাবে না।’
এই দশদিন একা থাকুন, আল্লাহর সাথে থাকুন। তাওবাহ, ইস্তিগফার, কিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, যিকিরে মশগুল থাকুন সর্বক্ষণ। অতীতের ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠে এই দশদিন আল্লাহর সাথে সম্পূর্ণ নতুন সম্পর্ক তৈরি করুন। ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগান, মজবুত করুন।
(৭) জীবনের সেরা দশ দিন
আমাদের সালাফগণ যৌবনে থাকতেই বলতেন, ‘আল্লাহর ইবাদতের জন্য আমরা দ্রুতগামী ঘোড়ার ন্যায় দৌড়াচ্ছি।’ এমন নয় যে তাঁরা বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতেন, বরং যুবক থাকতেই নিজেদের সবকিছু দিয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতেন।
আমাদের রমাদানের শেষ দশদিন যেন রমাদানের প্রথম বিশ দিনের মতো না হয়। আমরা কেউই জানি না, আগামী রমাদান আদৌ পাব কিনা। হয়ত তার আগেই আমাদের অন্ধকার কবরে আশ্রয় নিতে হবে। আসলে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার সময় মুমিন এবং পাপী উভয়ই আফসোস করে। মুমিন আফসোস করে এই ভেবে, কেন আরেকটু বেশি ইবাদত করে গেলাম না। আর পাপী আফসোস করে, কেন বেঁচে থাকতে আল্লাহর কাছে ফিরে এলাম না।
আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিক।
Leave a Reply