রাগ এমন একটি গুণ, যা সমগ্র সৃষ্টিকুলের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। মানুষের ন্যায় পশু-পাখিরাও রাগ করে, আচার আচরণে তাদের রাগ প্রকাশ করে। তবে পশু-পাখির সাথে মানুষের রাগের প্রধান পার্থক্য হলো, মানুষের ভালো রাগ মন্দকে প্রতিহত করতে অত্যন্ত কার্যকরী, আর খারাপ রাগ অতি মাত্রায় বিধ্বংসী। যেখানে রাগ করা উচিত, সেখানে নীরবতা পালন কাপুরুষতার পরিচায়ক। তেমনি যেখানে নীরব থাকা কাম্য, সেখানে রাগ দেখানো নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। তাই আসল কৃতিত্ব উভয়ের মাঝে ভারসাম্য রাখায়।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা রাগের সময় পথচ্যুত হই। রাগের বশে এমন কিছু করে ফেলি, যার জন্য ভবিষ্যতে অনেক মাশুল গুণতে হয়। রাগের মুখে বলা স্রেফ একটি কথার দরুন কত সংসার ভেঙেছে, কত মন টুকরো টুকরো হয়েছে, কত বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিণত হয়েছে, এর হিসেব নেই। রাগের ক্ষতি নিয়ে ফিরিস্তিরও শেষ নেই। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরী একটি বিষয়। পুরাতন কথা হলেও বার বার নিজেকে স্মরণ করাতে হয়। আসুন কিছু জরুরী পদক্ষেপের কথা জানা যাক, রাগের মুহূর্তে যেগুলো টনিকের মতো কাজ করে:
(১) আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া
সুলাইমান ইবনু সুরাদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে দু’ব্যক্তি কথা কাটাকাটিতে প্রবৃত্ত হলো। তাদের একজনের দু’ চোখ (রাগে) লাল হয়ে খাড়া হয়ে গেল রগরেশ। রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘আমি এমন একটি কালিমা জানি, যা যে কেউ পাঠ করলে তার রাগ দূর হয়ে যায়। আর তা হচ্ছে أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ (আমি বিতাড়িত শয়তানের থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই)।’ [সহীহ মুসলিম, (৬৪৫৮)]
(২) চুপ হয়ে যাওয়া
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রাগান্বিত হয়, সে যেন চুপ হয়ে যায়।’
[মুসনাদে আহমাদ (১/৩২৯), সহীহ আল জামি (৬৯৩, ৪০২৭)
কেননা রাগের মুহূর্তে আমাদের মুখ লাগামহীন হয়ে পড়ে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্যের কোঠায় নেমে যায়, ফলে তখন এমন কথা মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে, যার জন্য পরবর্তী অনেক পস্তাতে হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষণিকের নীরবতা ভবিষ্যৎ অনেক শঙ্কা থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
(৩) অবস্থান পরিবর্তন করা
আবূ যার (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের বললেন ‘যদি তোমাদের কেউ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রাগান্বিত হয়, তবে সে যেন বসে পড়ে। যদি এতে রাগ চলে যায়, তবে ভাল; নয়তো সে শুয়ে পড়বে।’
আতিয়াহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত; আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আর শয়তান আগুন হতে সৃষ্ট। আগুনকে পানিই নেভাতে পারে। কাজেই তোমাদের কেউ রাগান্বিত হলে সে যেন ওযু করে।’ [আহমাদ (১৮১৪৮), আবু দাউদ (৪৭৮৪)]
(৪) আল্লাহর নবীর অসিয়ত স্মরণ করা
আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত; এক লোক নবী (ﷺ)-এর সমীপে আবেদন জানাল, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, ‘তুমি রাগান্বিত হয়ো না।’ লোকটি আবার একই আবেদন জানাল। তিনি (প্রতি বারেই) তাকে এই অসিয়ত করলেন, ‘তুমি রাগান্বিত হয়ো না।’ [সহীহুল বুখারী (৬১১৬), তিরমিযী (২০২০)]
রাসূলুল্লাহ বলেন, ‘ধরাশায়ী করার মাঝে কৃতিত্ব নেই। বরং রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার মাঝেই আসল কৃতিত্ব।’ [আহমাদ (২/২৩৬)]
আলী ইবনে হুসাইন (রাযি.) বলেন, ‘বান্দার রাগ আল্লাহর রাগের নিকটবর্তী করে।’
(৫) রাগ দমনের সাওয়াব
আল্লাহ বলেন, ‘ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। উৎকৃষ্ট দ্বারা মন্দ প্রতিহত করো; তাহলে যাদের সাথে তোমার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। এ চরিত্রের অধিকারী কেবল তারাই হয়, যারা ধৈর্যশীল; এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয়, যারা মহা-ভাগ্যবান। যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা ফুসসিলাত, ৪১: ৩৪-৩৬]
মুত্তাকীদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,
الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ
‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে থাকে। আর আল্লাহ মুহসিনদের ভালোবাসেন।’ [সূরা আলে ইমরান, ৩: ১৩৪]
নবীজি (ﷺ) বলেন, ‘রাগ করো না, তাহলে জান্নাত তোমার।’ [সহীহ আল-জামিঈ (৭৩৭৪)]
নবিজি আরও বলেন, ‘যে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাগ দমন করে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার অন্তরকে সন্তুষ্টি তারা পূর্ণ করে দেবেন।’ [তাবারানী (১২/৪৫৩), সহীহ আল-জামিঈ (১৭৬)]
তিনি আরও বলেন, ‘সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তার রাগ দমন করে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাঁর গোটা সৃষ্টির সম্মুখে তাকে ডাকবেন এবং তাকে যে হুর ইচ্ছা নির্বাচন করতে দেবেন।’ [আবু দাউদ (৪৭৭৭), সহীহ আল-জামিঈ (৬৫১৮)]
আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমলের তাওফীক দান করুক এবং রাগের সময় আমাদের সাহায্য করুক।
Leave a Reply