মৃত্যু মানব জীবনে একটি অবধারিত বিষয়। এ থেকে পালাবার জো নেই। মৃত্যুকে রোধকারী কোনো ঔষধও নেই। মহামারির এই কঠিন সময়ে যে বিষয়টি আমাদের জানা অত্যন্ত জরুরী, কীভাবে আমরা নেক মৃত্যু লাভ করতে পারি। মৃত্যুর এই মিছিলে শামিল হবার আগেই কীভাবে আমরা নিজেদের গড়ে নিতে পারি। যেন ওপারের জীবনটা সুখকর হয়, দুনিয়াতে কষ্ট হলেও আখিরাত যে আনন্দের হয়। তাই আসুন, নেক মৃত্যু লাভের কিছু উপায় জেনে নিই:
(১) ইখলাস: খাঁটি নিয়ত
ইন্নামাল আ’মালু বিন-নিয়্যাহ, নিয়তের ওপর ফলাফল নির্ভরশীল। বিখ্যাত এই হাদীসটি আমরা অনেকেই জানি। এই হাদীসের ব্যাখ্যায় অতীতের অনেক আলিম বলেন, জীবনকে আমরা যেভাবে সাজাবো, মৃত্যুর সময় সে ঠিক সেই ফলাফলই এনে দেবে। অর্থাৎ আমাদের মৃত্যু আমাদের গোটা জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তাই নেক মৃত্যু লাভের প্রধান শর্ত হচ্ছে, জীবনটা পুরোপুরি আল্লাহর জন্য সাজানো। তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে, তাঁর বিধান মেনে বাকি জীবন কাটানো।
(২) সালাতের প্রতি যত্নশীল হওয়া
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুই ঠাণ্ডা (অর্থাৎ ফজর ও আসরের) নামায পড়বে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [সহীহুল বুখারী ৫৭৪, মুসলিম ৬৩৫]
কেন এই দুই ওয়াক্তের সালাত এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, এই দুই সময়ে সবচেয়ে আলস্য অনুভব করে মানুষ। ফজরে উঠতে পারে না ঘুমের অজুহাতে, আর আসর বাদ যায় জাগতিক ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে। তাই যে এই দুই ওয়াক্ত সালাতের ব্যাপারে যত্নশীল, তার ব্যাপারে এটাও আশা করা যায়, বাকি ওয়াক্ত-গুলোতে সে সালাত আদায় করবে।
(৩) ঈমানের ওপর অবিচলতা: আত্মশুদ্ধি
নেক মৃত্যু লাভের অন্যতম উপায় হলো আত্মশুদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা। জগত পরিবর্তনশীল, তার চেয়েও বেশি পরিবর্তনশীল মানব মন। সকালে যদি ঈমানকে তুঙ্গে দেখতে পায়, সন্ধ্যা গড়াতেই মনে হবে ঈমানের আকাশ ভেঙে পড়েছে। তাই নিজের অন্তরের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকা জরুরী। নেক আমলের পাশাপাশি অন্তর নরম-কারী বইপত্র পড়া, লেকচার শ্রবণ জারি রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং যে ঈমান আনবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে, তার কোন ভয় নেই এবং সে চিন্তিতও হবে না।’ [সূরা আনআম, ৬: ৪৮]
অর্থাৎ আখিরাতে আগত অবস্থার কোনো ভয় তাদের স্পর্শ করবে না। নিজেদের পশ্চাতে দুনিয়ায় যা কিছু ছেড়ে এসেছে, অথবা দুনিয়ার যেসব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তারা ভোগ করতে পায়নি, তার জন্য তারা দুঃখিতও হবে না। [তাফসীর আহসানুল বায়ান]
(৪) গোপনে, প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা
একাকী ঘরে, জনবহুল পরিবেশে—যে অবস্থায় থাকুন, তাকওয়াকে আঁকড়ে ধরুন। পরিবেশ পরিস্থিতি যেন আপনাকে আল্লাহর দাসত্ব ছেড়ে শয়তানের দাস বানাতে না পারে। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্যই।’ [সূরা কাসাস, ২৮: ৮৩]
(৫) শিরক এবং কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা
মানুষ মাত্রই ভুল। ভুলে যাওয়া, ভুল হওয়া মানুষের বৈশিষ্ট্য। আমরা ফেরেশতা নই। তাই আত্মশুদ্ধির কথা যখন বলা হয়, তখন আপনাকে সবার আগে শিরক এবং কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার কথা বলা হয়। বড় গুনাহগুলো থেকে যদি আমরা বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে ছোট গুনাহগুলো আল্লাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা কবিরা গুনাহ, তা থেকে বিরত থাকলে আমি তোমাদের ছোট পাপগুলো ক্ষমা করে দিবো, এবং তোমাদের প্রবেশ করাব সম্মানজনক স্থানে।’ [সূরা নিসা, ৪: ৩১]
(৬) যুলুম থেকে বিরত থাকা
ইতিহাস বলে অধিকাংশ মানুষের খারাপ মৃত্যুর পেছনে একটি প্রধান কারণ ছিল, জীবিত অবস্থায় তারা মানুষের প্রতি যুলুম করত। অন্যের মান সম্মান ভূলুণ্ঠিত করত, অন্যায়ভাবে সম্পদ গ্রাস করত, অন্যের হক মেরে দিতো। এ জন্য নবীজি বলেছেন, ‘মাযলুমের দুআ থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, তার এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই।’ [বুখারী ২৪৪৮, মুসলিম ১৯]
আরেক হাদীসে বলেন, ‘এই দুটোর মতো এমন কোনো গুনাহ নেই, যা আল্লাহর শাস্তিকে দ্রুত ডেকে আনে: (১) অত্যাচারী হওয়া, (২) রক্তের সম্পর্ক নষ্ট করা।’ [আহমাদ (৫/৩৬), আবু দাউদ ৪৯০২, তিরমিযী ২৫১১]
(৭) বিদআত বা দ্বীনের নামে নব আবিষ্কৃত রীতি নীতি
সামাজিকতার দোহাই দিয়ে এমন কোনো আমল করবেন না, শরীয়তে যার কোনো স্থান নেই। এটি অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। কারণ, যে পাপ করে, সে অনুশোচনায় ভুগে, তার তাওবার আশা করা যায়। কিন্তু যে বিদআত করে, সে তা নেক আমলের নিয়তে করে, তাই তাওবার আশা করা যায় না। নবীজি বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ [সহীহ মুসলিম ১৫৩৫, সুনান আন-নাসায়ী ১৫৬০]
(৮) নেক মৃত্যুর জন্য দুআ করা
দুআ বিশ্বাসীদের হাতিয়ার, জমিনে বসে আরশের অধিপতির সাথে সংযোগের মাধ্যম। দুআ মুমিনের ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে, শাস্তি নামার আগেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যালিমের অনিষ্ঠ থেকে বাঁচাতে পারে। তাই দুআ শুধু জাগতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন না। এতে পরকালের অংশও রাখুন। নেক মৃত্যু চেয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করুন, কায়মনোবাক্যে ডাকুন। নবীজি (ﷺ)-এর একটি দুআ ছিল:
اَللَّٰهُمَّ تَوَفَّنَا مُسْلِمِيْنَ، وَأَحْيِنَا مُسْلِمِيْنَ، وَأَلْحِقْنَا بِالصَّالِحِيْنَ غَيْرَ خَزَايَا وَلاَ مَفْتُونِينَ
‘ও আল্লাহ, আমাদেরকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করুন, মুসলিম অবস্থায় জীবিত করুন। কোনো প্রকার লাঞ্ছনা এবং পরীক্ষা ছাড়াই নেককারদের সাথে আমাদের মিলিত করুন।’ [বুখারী, আদাবুল মুফরাদ ২৩৯, ৬৯৯]
Leave a Reply