মার্কেট মহামারী: যেখানে আমরা দ্বীন হারাচ্ছি

‘কিয়ামত ততদিন সংঘটিত হবে না, যতদিন না বাজারগুলো একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসে।’
— রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
(আহমাদ ২/৫১৯)

বর্তমানে মার্কেট খুব হাতের নাগালে চলে এসেছে। গ্লোবালাইজেশনের ফলে নামীদামী আন্তর্জাতিক ব্রান্ড এখন এক ছাদের নিচের পাওয়া যায়। এটা যেন নবীজি সা.-এর ভবিষ্যদ্বাণীরই প্রমাণ।

এই দিকে রমাদান মাস এলে আমরা অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি ঈদের বাজার করতে। যে কাজ ১-২ দিনে করা যায়, সেটা সপ্তাহ, কেউ বা গোটা মাস লাগিয়ে দিই। ২ ঘণ্টার কাজ ৫ ঘণ্টা নিয়ে করি। ফলে রমাদানের মৌসুমে যেখানে আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা ছিল ইবাদত বন্দেগীতে, সেখানে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি দুনিয়া গড়তে।

শাইখ আব্দুল আযীয আত-তারিফী (হাফি.) বলেন, “রমাদান মাসে রোযাদের ব্যক্তির জন্য উচিত নয়, সে ভ্রমণে ব্যস্ত থাকবে এবং আমলে পিছিয়ে পড়বে। বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে, আয়িশা (রাদ্বি.) বলতেন, ‘আমি রমাদান মাসে ভ্রমণ করা পছন্দ করি না। রমাদান শুরু হলে আমি ঘরে থাকতেই পছন্দ করি।’”

মার্কেট এমন জায়গা, যা আল্লাহর প্রতি উদাসীন করে তোলে। ইবনু আব্বাস (রাদ্বি.) বলেছেন, ‘কেউ হয়ত নিশ্চিন্ত মনে বাজারে হেঁটে বেড়াচ্ছে, অথচ তার নাম সেসব ব্যক্তিদের মাঝে নির্ধারিত হয়ে গেছে, যারা শীঘ্রই মারা যাবে।’ (হাকিম, ২/৪৮৭)

সাহাবী আবু দারদা (রাদ্বি.) বলতেন, ‘মুসলিমদের জন্য শ্রেষ্ঠ নির্জনবাসের স্থান হলো তার ঘর, যেখানে সে তার দৃষ্টি ও আব্রুর হেফাজত করতে পারে। বাজারের ব্যাপারে সাবধান! কারণ, এগুলো মানুষকে অসার কাজকর্মে ব্যস্ত হতে এবং গাফেল হতে উদ্বুদ্ধ করে।’ (শুয়াবুল ঈমান, ৭/৩৭৯)

মালিক বিন দীনার (রহ.) বলতেন, ‘বাজার সম্পদ বাড়াতে থাকে আর দ্বীন কমাতে থাকে।’ (হিলইয়া, ২/৩৮৫)

মার্কেট সহজলভ্য এবং হাতের নাগালে হওয়ায় বর্তমানে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা যায় নারী সমাজের। তাদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, হিংসা, ইত্যাদি কারণে তারা এই ঝোঁক অনুভব করে। কিন্তু একজন পরহেজগার নারী কখনই এসব প্রতিযোগিতায় জড়ায় না। তারা সবসময় হাসান বাসরি (রহ.)-এর এই উপদেশটি মনে রাখে। তিনি বলতেন:

‘যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমার সাথে প্রতিযোগিতা করে, তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করো। আর যারা দুনিয়ার ব্যাপারে তোমার সাথে প্রতিযোগিতা করে, তা তাদের মুখের ওপর ছুড়ে মারো।’ (ইহইয়া উলুমুদ্দীন, ৩/২০৭)

তাহলে কি মার্কেট যাওয়া একদমই খারাপ?

না। বিষয়টি এমনও না। আল্লাহ তাআলা আমাদের জানিয়েছেন যে, রাসূল সা. ও অন্যান্য নবীগণ হাট বাজারে যেতেন। (দেখুন সূরা ফুরকান, ৭)। আল্লাহর নেককার বান্দারাও হাট বাজারে যেতেন। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, তারা আমাদের মতো গাফেল হয়ে যেতেন না। (দেখুন সূরা নূর, ৩৭)

ইবনু আবু হুসাইল (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ ভালোবাসেন যে, তাঁকে বাজারে স্মরণ করা হবে। কারণ, সেখানে হট্টগোল আর উদাসীনতা বেশি। আমি আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করার একক উদ্দেশ্য নিয়েই বাজারে যাই।’ (হিলইয়া, ৯/২৯৫)

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাদ্বি.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি বাজারের মাথায় দাঁড়িয়ে দুআ করতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে এর মধ্যকার কল্যাণ এবং এর ভেতরে যা আছে সেসবের মধ্যকার কল্যাণ কামনা করি। আর আমি আপনার কাছে এর অকল্যাণ এবং এর ভেতরে যা আছে সেসবের মধ্যকার অকল্যাণ থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।’ (মুজামুল কাবির, ৯/১৮১)

জমিনে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান মাসজিদ, আর সবচেয়ে ঘৃণিত স্থান বাজার (মার্কেট)।’ (সহীহ মুসলিম, ৬৭১)

ইমাম নববী (রহ.)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ, কারণ এখানে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করা হয় এবং তা তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর বাজার আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত স্থান, কারণ এ জায়গায় লোক ঠকানো, ধোঁকা দেওয়া, সুদ, মিথ্যা শপথ, কথা দিয়ে কথা না রাখা, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হওয়ার মতো কাজগুলো হয়ে থাকে।’ (সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, ইমাম নববী, ৫/১৭১)

নবীজির হাদীস, পূর্বসূরীদের শিক্ষা, হালাল হারাম বিধান—সামগ্রিক বিষয় সামনে রেখে আলিমগণ মার্কেটে গমনকারী সাধারণ মানুষদেরকে নসিহত করে থাকেন। সেসব নসিহতকে একসাথে শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ তার ইলেকট্রনিক গেমস এবং কমার্সিয়াল সেন্টারের মহামারি বইতে উল্লেখ করেছেন। সেখান থেকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:

১) একজন আদর্শ মুসলিম শুধু প্রয়োজনের খাতিরেই বাজার-মার্কেটে যাবে, এমনি এমনি ঘোড়াফেরার জন্য না।

২) শপিং কমপ্লেক্সের উপর পথঘাটের বিধান প্রযোজ্য। আবু সাইদ আল-খুদরি থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেন, “পথের উপর বসা থেকে সাবধান।” সাহাবাগণ বললেন, “আমাদের তো আর উপায় নেই। দরকারি কথাবার্তা বলার জন্য আমাদের সেখানে বসতেই হয়।” রাসূল বললেন, “যদি বসতেই হয়, তাহলে পথের হক আদায় করো।” জিজ্ঞেস করা হলো, “পথের হক কী কী?” তিনি বললেন, “দৃষ্টি অবনত করা, অন্যের ক্ষতি না করা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা।” (বুখারী ২৩৩৩, মুসলিম ২১২১)। শপিং কমপ্লেক্সে বসে থাকা ব্যক্তিদেরও এ সকল আদব মানতে হবে।

৩) ক্রমাগত আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। এ ব্যাপারে হাদীস ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪) বাজারে প্রবেশের দু’আ পড়া। ক্রেতা, বিক্রেতা, দর্শনার্থী সকলকেই এই দু’আ পড়তে হবে, যা রাসূল বাজারে ঢোকার সময় পড়তেন।

لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ، وَهُوَ حَيٌّ لاَّ يَمُوْتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، وَهُوَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ
অর্থ: “আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন অংশী নেই। তাঁরই নিমিত্তে সারা রাজত্ব ও সকল প্রশংসা। তিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু দান করেন। তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁরই হাতে যাবতীয় মঙ্গল এবং তিনি সর্ব বস্ত্তর উপর সর্বশক্তিমান।”

বাজার প্রবেশ করে এই দু‘আটি যে পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য ১০ লক্ষ পুণ্য লিপিবদ্ধ করবেন, তার ১০ লক্ষ পাপ মোচন করে দেবেন, তাকে ১০ লক্ষ মর্যাদায় উন্নীত করবেন এবং জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করবেন।’ (তিরমিযি ৩৪২৮)

এ ছাড়া সাধারণভাবে সকল জায়গায় যেকোনো সময় সেসব আয়াতও বলা যায়, যা আল্লাহর স্মরণের দিকে ডাকে। শুধু যেসব জায়গায় আল্লাহর নাম উচ্চারণ হারাম, সেসব জায়গা বাদে। যেমন : টয়লেট।

৫) পুরুষরা সবসময় দৃষ্টি অবনত রাখবেন।

৬) ঝগড়া বিপাদ পরিত্যাগ করবেন, সালাম দিবেন।

৭) অপচয় করবেন না। অদরকারি জিনিসপত্র কিনে ঘর ভর্তি করবেন না।

৮) নারীদের বেশি বেশি ঘরের বাহিরে বের হওয়া উচিত নয়। একান্তই যদি যেতে হয়, তাহলে শরিয়ত ন্রিরধারিত পূর্ণ পর্দার পাশাপাশি অবশ্যই লজ্জাশীলতা ও শালীনতা বজায় রাখবেন।

৯) নারীরা একাকী মার্কেটে যাবেন না। মাহরাম পুরুষ বা স্বামীসহ যাবেন।

১০) পারতপক্ষে পুরুষ দোকানদারের সাথে কথা বলবে সাথে থাকা পুরুষ। নারীর কথা বলা লাগলে নরম কণ্ঠ পরিহার করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে শুধু প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলবে।

১১) পণ্য বা টাকা আদান-প্রদান করতে গিয়ে গায়রে মাহরাম দোকানদারের সাথে হাত যাতে লেগে না যায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

১২) নারীরা দোকানদারের সাথে যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখবে। নির্জন দোকানে প্রবেশ করা ঠিক হবে না। আশপাশে মানুষজন আছে এমন জায়গায় শপিং করা উচিত।

১৩) দোকানে বা টেইলার্সে কাপড়ের মাপ দেওয়ার জন্য কাপড় খোলা যাবে না।

১৪) নারীরা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে মার্কেটে যাবেন। একবারেই বের হয়ে সব দরকারি জিনিস কিনে ফেলুন। এতে সময়, শ্রম ও টাকা বাঁচবে।

১৫) নারীরা বান্ধুবীদের সাথে দলবেঁধে শপিং এ না যাওয়া উচিত। তখন একে অপরের দেখাদেখি দামি বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা এবং পরস্পর প্রতিযোগিতা করার মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।

১৫) সাধারণভাবে সবাই পিক আওয়ারে শপিং করা পরিহার করুন। যেমন, বন্ধের দিন বা রমাদানের রাত। কতক্ষণের মধ্যে কেনাকাটা শেষ করতে হবে, তার রুটিন ঠিক করে নিন।

১৬) এমন দোকান খুঁজে নিন যেখান আপনার দরকারি সব জিনিস বা বেশির ভাগ জিনিস একসাথে পাওয়া যায়।

পরিশেষে ঘরের কর্তারা একটি হাদীস স্মরণে রাখবেন। রাসূল সা. বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই এ দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো জাতির নেতা সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল। পুরুষ তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। নারী তার স্বামীর বাড়ি ও সন্তানদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। দাস তার মনিবের সম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারী, ৫১৮৮, মুসলিম ১৮২৯)

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *