মহান রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে বহু নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু আল্লাহর দেওয়া এই বিপুল নিয়ামতরাজির মধ্যে এমন কোনো নিয়ামত নেই, যা কুরআনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কুরআনের মতো মূল্যবান আর কোনো নিয়ামত নেই, হতেও পারে না। কেননা এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর নিজের কথামালা, কুরআনের মাধ্যমে আপনি সরাসরি আপনার মালিকের সাথে কথা বলার বিশাল সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন! সুব’হানাল্লাহ!
এই কুরআন হচ্ছে আপনাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবার পথ। এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উপায়। কুরআনই আপনাকে দেখিয়ে দেবে জান্নাতের অমরত্ব লাভের সুনিশ্চিত রাস্তা। কুরআনই হচ্ছে সুকূন আর এর মাধ্যমেই আসে সফলতা।
অতএব কুরআনকে বুঝার, একে অনুধাবন করার, এর মর্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করার বিন্দুমাত্র বিকল্প নেই। একজন মুসলিম কুরআনকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তার চলার পথে যত ধরনের দিকনির্দেশনা দরকার, তার প্রতিটির উৎসমূল হচ্ছে এই মহাগ্রন্থ। তাই কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, কুরআন নিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে গবেষণা করা সব স্তরের মুসলিমের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।
কুরআন অনুধাবন
কুরআন থাকা উচিত ছিল আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে। কুরআনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবার কথা ছিল আমাদের সকল চিন্তা, কথা, কাজকর্ম। কিন্তু আমাদের আলস্য আর অবহেলার কারণে আমরা আজ এটা থেকে অনেক দূরে। এ জন্যই আমাদের অন্তরের ইসলাহ হয় না, আমাদের কাজগুলোও সংশোধিত ও বরকতপূর্ণ হয় না। কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা তথা কুরআন নিয়ে তাদাব্বুরের মহাগুরুত্ব উপলব্ধি করতে চাইলে ইবনে হুবায়রা রাহিমাহুল্লাহর এই একটি কথাই যথেষ্ট –
“শয়তানের একটি বড় যন্ত্রণা হলো, কুরআন নিয়ে মানুষের তাদাব্বুর-চিন্তা ফিকির করা। কারণ, শয়তান জানে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করলেই হিদায়াত লাভ হয়।”
অতএব হিদায়াতের রাজপথে হেঁটে জান্নাতের সবুজে প্রবেশ করতে চাইলে কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। এটা ছাড়া আপনার আমলের মধ্যে প্রাণ আসবে না, আপনার ঈমান জীবন্ত হয়ে উঠবে না। কুরআনের তাদাব্বুর ছাড়া কুরআনের ফুল দিয়ে আপনি আপনার জীবন সাজাতে পারবেন না। তাই কুরআন থাকতে হবে আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় আমাদেরকে আয়াতের বক্তব্য নিয়ে ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার প্রকাশভঙ্গী নিয়ে, খেয়াল রাখতে হবে এর শব্দ ও অর্থের দিকে, জেনে নিতে হবে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল এই আয়াত। এভাবেই কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিপূর্ণতা পাবে।
কুরআন তাদাব্বুরের ১০টি পদ্ধতি
কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা বা তাদাব্বুর করার অসংখ্য পদ্ধতি রয়েছে। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম আলোচনাও করেছেন। এখানে আমরা তাঁদের আলোচনা থেকেই ১০টি পদ্ধতির কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
১। কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি: কুরআন নিয়ে চিন্তা করার, এর অন্তর্নিহিত রহস্য ও ভাব অনুধাবন করার এক নাম্বার পদ্ধতিই হচ্ছে কুরআনের সাথে সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলা। আমরা আমাদের একান্ত বিষয়-আশয় তাকেই বলে থাকি যে আমাদের খুব কাছের। আমাদের মনের কথাগুলো আমরা সেই বন্ধুকেই বলে থাকি যার সাথে আমাদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। কুরআনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্ক যতো গভীর হবে, আপনি ততো তার ভেতরের কথাগুলো জানতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। কুরআন যতো বেশি আপনি তিলাওয়াত করবেন, যতো বেশি সময় আপনি কুরআনের সাথে কাটাবেন ততো বেশি আপনি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার, এর গভীরতা থেকে মণিমুক্তা তুলে আনার কাজে পারঙ্গম হয়ে উঠবেন। কুরআনের সাথে আপনার সম্পর্কের গভীরতা অনুযায়ী কুরআন তার রহস্য আপনার কাছে উন্মোচিত করবে। সম্পর্ক যত গভীর হবে, কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনাও ততোই গভীরে গিয়ে পৌঁছুবে।
২। ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে কুরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করা: কুরআন তিলাওয়াতে তাড়াহুড়া এমনিতেই পরিত্যাজ্য। তার উপর যদি আপনি তাদাব্বুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে দ্রুত তিলাওয়াতের চিন্তা পরিহার করতে হবে। একবার ভেবে দেখুন তো, কেউ যদি খুব দ্রুত কোনো কথা বলে যায় তবে কি আপনি তার কথার মর্ম ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারবেন? পারবেন না। সে খুব হৃদয়গ্রাহী কথা বলতে পারে, কিন্তু তার দ্রুততা কথার আবেদনকে আপনার পর্যন্ত পৌঁছুতে দেবে না। কুরআনের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটবে যদি আপনি স্রেফ দ্রুততার সাথে আয়াতগুলো আওড়ে যান। কিন্তু যদি আপনি কুরআন নিয়ে ভাবতে চান, কুরআনকে আপনার হৃদয় স্পর্শ করতে দিতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য চেষ্টা করতে হবে। শেষ করার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে এর মর্ম অনুধাবনের চেষ্টায় রত থাকতে হবে।
৩। তিলাওয়াতের সময় অন্তরকে হাজির রাখা: একে আমরা বলতে পারি শুধু শরীরের কান দিয়ে না শুনে মনের কান দিয়ে শোনা। আপনাকে অবশ্যই অন্তর দিয়ে কুরআনকে শুনতে হবে, পড়তে হবে। আপনি যখন তিলাওয়াত করছেন তখন আপনার যবান তো কুরআনের আয়াত উচ্চারণ করে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। এমন অবস্থায় কখনোই কুরআন নিয়ে চিন্তা করতে আপনি সক্ষম হবেন না। আপনাকে অবশ্য অবশ্যই আপনার অন্তরকেও কুরআন তিলাওয়াতকালে সমানভাবে হাজির রাখতে হবে। আপনাকে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে যাতে তিনি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং তাঁর কালামকে আপনার অন্তরে বদ্ধমূল করে দেন।
৪। তিলাওয়াতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা: কুরআন তিলাওয়াতের সময় অবশ্যই আপনাকে মাথায় রাখতে হবে কেন আপনি এই কিতাব তিলাওয়াত করছেন। ড. খালিদ বিন আব্দিল কারীম মুহাম্মাদ হাফিযাহুল্লাহর মতে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় ৫টি উদ্দেশ্য আপনার সামনে থাকা চাই। এগুলো হলো, ইলম অর্জন, কুরআন অনুযায়ী আমল, রবের সাথে কথোপকথন, সাওয়াব লাভ ও রোগ থেকে শিফা লাভ। এগুলো সামনে রেখে কুরআন তিলাওয়াত করলে নিশ্চয়ই তা আপনার জন্য কল্যাণকর চিন্তার দুয়ার খুলে দেবে, যা আপনাকে সাহায্য করবে কুরআনের গভীরে পৌঁছাতে এবং কুরআন থেকে উপকৃত হতে। তাছাড়া লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বিহীন কোনো কাজই সফলতা লাভ করতে পারে না। কুরআনের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি আরো বেশি সত্য।
৫। নামাযে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া: নামাযের মধ্যে আমরা কুরআন তিলাওয়াত করেই থাকি। কিন্তু তবুও নামাযে আলাদাভাবে এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে। নামাযে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা কুরআন নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার দ্বারকে উন্মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ। বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাযে এই বিষয়টির দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ তখন সময়টা থাকে নির্ঝঞ্ঝাট, নীরব, সুনসান। কুরআন নিয়ে ভাবার, কুরআনের অতলে ডুব দেবার জন্য এই সময়টিই সবচেয়ে উপযুক্ত। আর এই সময়ে নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত তাদাব্বুরের জন্য সেরা একটি পদ্ধতি।
৬। একটি আয়াত বারবার পড়া: কুরআন তাদাব্বুরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, একটি আয়াত একাধিকবার পড়া। বারবার পড়ে পড়ে আয়াতটি মনের মধ্যে গেঁথে ফেলা এবং এর মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করা। কুরআন নিয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি ও কার্যকর একটি পদ্ধতি।
৭। কুরআনের আয়াতকে জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখা: কুরআন নিয়ে চিন্তা করার জন্য এটি আরো একটি কার্যকর পদ্ধতি। কুরআনে প্রচুর উদাহরণের উল্লেখ দেখা যায়। সেই উদাহরণগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা। আল্লাহ যেখানে যেখানে উপমা দিয়েছেন সেগুলোকে সেভাবে চিন্তা করা। যেমন, আল্লাহ কুরআনে পার্থিব জীবনকে শস্যক্ষেতের সাথে তুলনা দিয়েছেন। এই বাস্তব উদাহরণগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। এই উপমাগুলো আল্লাহ এজন্যই দিয়েছেন যাতে আমরা এগুলো নিয়ে ভাবি এবং এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করি। কুরআনের আয়াতকে যতো বেশি আমরা জীবনের সাথে মিলিয়ে পড়বো, যতো বেশি নিজেদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলীর সাথে কুরআনের বক্তব্যের মিল খুঁজবো, কুরআন থেকে আমি ততো বেশি ফায়দা হাসিল করতে পারবো। কুরআন নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা ততো বেশি পোক্ত হবে, সমৃদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।
৮। খুব গভীরভাবে কুরআনের আয়াত মুখস্থ করা: কুরআনের যে কয়টি আয়াতই আমরা মুখস্থ করি না কেন, সেগুলো এমনভাবে মুখস্থ করা যেন কোথাও শুনলেই সেগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এতে করে এই আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
৯। মুখস্থ অংশটুকু প্রতি সপ্তাহে আবার পড়া: কুরআন নিয়মিত যতোটুকুই সম্ভব মুখস্থ করতে চেষ্টা করতে হবে। আর যতোটুকুই মুখস্থ করুন না কেন, সেটা পরের সপ্তাহে আবার পড়ুন। একবার পড়েই পরবর্তী অংশে চলে যাবেন না। বরং পঠিত অংশ বারবার পড়ে সেটাকে নিজের মধ্যে গেঁথে নিন এবং তার অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা অব্যাহত রাখুন।
১০। পঠিত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা: কুরআনের প্রতিটি আয়াতেরই শানে নুযূল রয়েছে। সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আল্লাহ সুব’হানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনের আয়াতসমূহ একের পর এক নাযিল করেছেন। যদি আপনি আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট জেনে সেই আয়াতটি পড়েন তবে বাস্তবতার সাথে আয়াতকে যেমন আপনি আরো বেশি মেলাতে পারবেন ঠিক তেমনি আয়াতের মর্ম ও বাস্তবতা অনুধাবনেও পাবেন নতুন চিন্তার খোরাক।
এই আর্টিকেলে আমরা চেষ্টা করেছি আল্লাহর কালামকে বুঝার, জানার, অন্তরে ধারণ করার জন্য এর আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর করার কিছু পদ্ধতি তুলে ধরার। এতে আপনারা উপকৃত হলে সেটা অবশ্যই আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর পক্ষ থেকে আর কোনো প্রকার ভুল হলে তা আমাদের তরফ থেকে। আল্লাহ আমাদের কুরআনের তাদাব্বুর করার তাওফীক দান করুন, তিনি আমাদের কুরআনের ফাহম দান করুন ও এর উপরই নিজেদের জীবন পরিচালনার তাওফীক দান করুন। আমীন।
কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনার পদ্ধতি জানতে এই বইগুলো উপকারি হতে পারে ইনশাআল্লাহ –
১। কুরআন অনুধাবন : পদ্ধতি ও সতর্কতা
২। তাদাব্বুরে কুরআন (কুরআন বোঝার রাজপথে আপনার প্রথম স্বপ্নযাত্রা)
৩। ৩০ মজলিসে কুরআনের সারনির্যাস
৪। ইলা রাওহিল কুরআন
৫। কুরআনের সাথে পথচলা
৬। কুরআনি ভাবনা
৭। খোলাসাতুল কুরআন
৮। কুরআন বোঝার মজা
৯। ম্যাসেজ অব কুরআন
১০। কুরআন জীবনের গাইডলাইন
Leave a Reply