ইসলামের আবির্ভাব পাল্টে দিয়েছিল উষর মরুর জাহিল মানুষগুলোকে। ঐশী পরশপাথরের ছোঁয়ায় তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন একেকটি স্বর্ণখণ্ড। তাঁদের কথা, কাজ, চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসতো জান্নাতী নূর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পতাকাতলে সমবেত হওয়া এই মানুষেরা ছিলেন পৃথিবীর বুকে বসবাস করা শ্রেষ্ঠতম মানুষ। আজ পর্যন্ত, এমনকি আজ এতোদিন পার হয়ে যাবার পরেও তাঁদের সমতুল্য আর কোনো জামা’আত ধরণীর বুকে আসেনি।
অনন্য সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই মানুষরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে ছিলেন একেকটি প্রেরণার বাতিঘর। তাঁদের ব্যাপারে যতো লেখা যায়, ততোই কম। ইসলাম ছিল তাঁদের জীবন আর তাঁরা ছিলেন ইসলামের তরে উৎসর্গীকৃত। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, যুদ্ধ, অর্থনীতি—কোথাও তাঁদের জুড়ি মেলা ভার! স্বর্ণযুগের এই মহানায়কদের ব্যাপারে আমরা কতোটুকুই বা জানি? অথচ তাঁরাই ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ। তাঁরা পাল্টে দিয়েছিলেন ইতিহাসের গতিপথ। তাঁদের সামনে মাথানত করেছিল পুরো বিশ্ব, তাঁদের বীরত্ব আর দাপটের সামনে মিশে গিয়েছিল পারস্য আর রোমান সাম্রাজ্যের পরাক্রম।
তাঁদের ব্যাপারে জানা, তাঁদের থেকে শেখা এগুলো আমাদের নিজেদেরকে গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য উপাদান। আমাদের অবশ্যই তাঁদের চেতনাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হবে, তাঁদের অনুসরণে ইসলামকে আবারো বিজয়ীর অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। দ্বীন থেকে দুনিয়া, সবক্ষেত্রে তাঁরাই আমাদের আদর্শের মাপকাঠি। এই মহানায়কদের জীবনকথা জানতে আপনাদের জন্য আজ আমরা নিয়ে এসেছি ৫টি বইয়ের সন্ধান।
সাইফুল্লাহিল মাসলুল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাদি.
বহুদূরে উড়ছে ধূলোর ঝড়। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে একদল অশ্বারোহী। প্রত্যেকের মধ্যেই অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার তীব্র প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। কিন্তু তাঁরা কখনোই তাঁদের সেনাপতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। তাঁদের সেনাপতি দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এক ব্যক্তি। লম্বা দাড়ি, চেহারায় অসংখ্য যুদ্ধজয়ের অভিজ্ঞতা আর কঠোরতার ছাপ। ওদিকে অপেক্ষমাণ শত্রু কাঁপছে থরথর! কারণ আল্লাহর তরবারির সামনে টিকতে পারে, এমন কোনো বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না কোথাও। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন ‘সাইফুল্লাহিল মাসলুল’, আল্লাহর তরবারিসমূহের মধ্যে একটি তরবারি। ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেওয়া এই উপাধিতেই। সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সেনাপতি হিসেবে যার জুড়ি আর কেউই নেই। তাঁর ঘোড়ার খুরে পদদলিত হয়েছে রোম-পারস্যের মতো জায়ান্টরা, সামরিক ইতিহাসের অবিসংবাদিত বিস্ময় তিনি। “সাইফুল্লাহিল মাসলুল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাদি.” সেই সামরিক বিস্ময়েরই জীবনগাঁথা।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা.
খুলাফায়ে রাশিদার যুগ শেষ হলে মুসলিমদের মধ্যে ফিতনা তীব্র আকারে ছড়িয়ে পড়ে। উমাইয়া খলিফাদের ব্যাপারে বেশ কিছু বিতর্ক দেখা দেয়। বাইয়াত গ্রহণে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে যুলুমের শিকার হন যুগশ্রেষ্ঠ সাহাবী ও তাবেয়ীগণও। সেই সময় পরিপূর্ণ নববী মানহাযে খিলাফাহকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সংগ্রামরত ছিলেন আমিরুল মুমিনীন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ফলে ক্ষমতাসীন উমাইয়াদের জন্য তিনি হুমকি হয়ে উঠেছিলেন। তাই তাঁকে দমনে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এই ধোঁয়াশাপূর্ণ অধ্যায়কে কেন্দ্র করে কেউ উমাইয়াদের ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আবার কেউ ইবনে যুবায়েরের খিলাফতকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এই বইটিতে ইবনে যুবায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জীবন, সংগ্রাম, লড়াই ও রাজনীতির ময়দানে তাঁর বিচক্ষণতার বিবরণ ও সে সময় তাঁর অবস্থান আহলুস সুন্নাহর মাপকাঠিতে বর্ণনা করা হয়েছে।
মুআবিয়া ইবনু আবি সুফিয়ান রা.
ইসলামের ইতিহাসে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর অবস্থান অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন ওয়াহী লেখকদের একজন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় শ্যালক এবং মুমিনদের নেতা। হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলিফার পদ ছেড়ে দিলে তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত হন এবং আবারো ইসলামের বিজয়ের ধারা ফিরিয়ে আনেন। তিনি ছিলেন সমুদ্রে যুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রথম ব্যক্তি। বিলাদুল মাগরিব থেকে খোরাসান পর্যন্ত তিনি ছড়িয়ে দেন ইসলামের বিজয় নিশান। তবুও তাঁকে শিকার হতে হয়েছে সাহাবা বিদ্বেষীদের অপপ্রচারের। এই বইটি তাঁর জীবনী তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁর সুউচ্চ মর্যাদার আলোকে জবাব দেবে মিথ্যুকদের সকল মিথ্যার এবং নিন্দুকদের সকল নিন্দার।
সীমান্তের মহাবীর
সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে পারস্যের মতো পরাশক্তির উপর হামলা চালানোর মতো সাহস যার তার থাকে না। হ্যাঁ, তিনি যদি হন সীমান্তের মহাবীর মুসান্না বিন হারিসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, তবে কথা ভিন্ন। মাত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে দুর্ধর্ষ এই সেনাপতি বারবার হামলা চালিয়েছেন বিশাল পারস্য বাহিনীর উপর। বিরল প্রতিভার অধিকারী এই সামরিক নেতা ভয় কাকে বলে, সেটা একেবারেই জানতেন না। পাহাড়ের অটলতা আর চিতার ক্ষিপ্রতা নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন শত্রুর উপর, তাঁর তেজোদ্দীপ্ত তলোয়ারে ছিন্নভিন্ন হয়েছে শত্রুদল সারির পর সারি। এই দুর্ধর্ষ সেনানায়কের রোমাঞ্চকর জীবনী তুলে ধরেছেন একজন সামরিক সদস্য, এক যোদ্ধার কলমে ফুটে উঠেছে আরেক যোদ্ধার উদ্দীপ্ত জীবনী।
হুসাইন ইবনু আলি (রা.)
জান্নাতের যুবকদের সর্দার হুসাইন ইবনু আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের ইতিহাসে খুব বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তিনি ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় নাতি। কারবালার ময়দানে নির্মমভাবে তাঁকে শহীদ করে দেওয়া হয়। কিন্তু মদীনা থেকে কারবালার দূরত্ব প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। কেন তবে এতোদূরে সফর করেছিলেন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু? নবীর ঘরে লালিতপালিত এই মহান ইমাম এতোদূর সফর করেছিলেন শুধুমাত্র হকের খাতিরে, উম্মাহর ভালোবাসায়। খিলাফাহর পবিত্র আসনকে রক্ষার জন্য দুনিয়ার পরিণতির বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে তিনি সফর করেছিলেন কারবালায়। কিন্তু যারা তাঁকে ডেকে নিয়েছিল, শেষমেশ তারাই করে প্রতারণা। কারবালার ময়দানে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হন তিনি, তাঁর সাথে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীসাথীরা। তাঁর জীবন আর কারবালার সেই বিদনাবিধুর ঘটনা ও এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত জানতে পড়ুন এই বইটি।
Leave a Reply