ইতিহাসের খেরোখাতায় ভারতীয় উপমহাদেশের কথা পাওয়া যায় বহু আগে থেকেই। সম্পদের প্রাচুর্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সহজে প্রবেশযোগ্য হওয়ায় বাইরের দুনিয়ার অভিযাত্রীরা বরাবরই ভিড় করেছে এই ভূমির দখল নিতে। সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হয়েছে বাংলাকে নিয়ে, যে অঞ্চলটি ছিল ভারতবর্ষের সমৃদ্ধতম অঞ্চল।
মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নায়কোচিত অভিযাত্রা দিয়ে শুরু হয় ভারতের বুকে মুসলিম শাসনের যুগ। মানুষ তখন অত্যাচারী রাজাদের যুলুমবাজি থেকে মুক্তির আশায় ছিল, বিন কাসিম তাঁদের জন্য হয়ে এসেছিলেন আল্লাহর রহমত হয়ে। বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের মধ্য দিয়ে। সেন রাজা লক্ষণ সেন পালিয়ে যাবার পর থেকে মুসলিম শাসনের অধীনে বাংলা সেজে ওঠে নতুন রূপে। সেন আমলে অবহেলিত বাংলা ভাষা পায় সম্মানের আসন। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রাণের সঞ্চার হয়।
উপমহাদেশ ও বাংলার ইতিহাস আমাদেরকে শুধু অতীতের গল্পকথাই শোনায় না, বরং নির্মাণ করে দেয় আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত। ইতিহাস বিকৃতি ও বিভিন্ন অপকৌশলে আজ যেভাবে পরিচয়ের সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে সর্বত্র, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জানার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। ইতিহাস আপনার জাতিসত্ত্বার শেকড়ের সন্ধান দেয়, আপনার প্রাসঙ্গিক অতীতের সাথে বর্তমানের সূত্র ধরে ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। ইতিহাসের আয়নায় দেখে নেওয়া যায় কেমন ছিল আমাদের অবস্থা আর সেখান থেকে আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। এই পাঠ নিতে হলে, নিজের অবস্থাকে বদলাতে হলে ইতিহাসের এই জরুরি পাঠ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যেই ইতিহাসের পাতায় বাংলা ও ভারতবর্ষের সেকালকে নানা আঙ্গিকে জেনে নিতে আমরা এখানে তুলে ধরছি ৫টি বইয়ের পরিচিতি।
সিন্ধু থেকে বঙ্গ (দুই খণ্ড)
অস্তিত্বের জন্য প্রতিটি মানুষের শেকড়ের সন্ধান জানা জরুরি। শেকড়কে জানতে হলে জানতে হবে ইতিহাস। বাংলাদেশের মুসলিম মানসের শেকড় জানতে হলে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস জানা জরুরি। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম শাসনের ইতিহাস অনেকটা অবহেলিত। ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই বারবার বদলেছে শাসক, বদলেছে শাসন। এগুলোর কারণ কী ছিল? কেমন ছিল তখনকার শিক্ষা, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক অবস্থা? মুসলিম শাসন ভারতবর্ষে কতটা ইসলামের ছাপ রাখতে পেরেছে? আর কতটা রাজনীতির ছাপ? এগুলো কি নিছক শাসনব্যবস্থা ছিল না ইসলামি শাসনব্যবস্থা? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর মিলবে দুই খণ্ডের এই গ্রন্থে। সাবলীলভাবে ইতিহাসের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে ভারতে মুসলিম শাসনের একদম সূচনালগ্ন থেকে।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন : হাজার বছরের ইতিহাস
কতো দেশের কতো ইতিহাস পড়া হয়, কিন্তু যে ভারতবর্ষের আমরা সন্তান তার ইতিহাস কতোটুকু জানি আমরা? জানার সুযোগও তেমন নেই। চাপা পড়ে গেছে কিংবা চাপা দেওয়া হয়েছে উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস। এই বইটি সেই অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করবে। ইসলামী শাসনের সূচনাকাল থেকে নিয়ে বিভিন্ন সালতানাতের শাসন, ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখল এবং তাদের নানান দুরভিসন্ধি নিয়ে এই বইটি রচনা করা হয়েছে।
ভারত যখন স্বাধীন হলো
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে ব্রিটিশদের হাতে। এরপর থেকে শুরু হয় যুলুম-নির্যাতনে ভরা এক বিভীষিকাময় শাসনকাল। আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ শক্তি নমনীয় হলেও স্বাধীনতার দাবিতে গড়িমসি করতে থাকে। দেশভাগের ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত নানান ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয়। ভারত বিভাগের এই প্রেক্ষাপট ও ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে কংগ্রেসের একটি মেয়াদের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের চিন্তা ও মূল্যায়ন উঠে এসেছে ’ভারত যখন স্বাধীন হলো’ বইটির মধ্যে। মাওলানা ছিলেন অবিভক্ত ভারতের পক্ষে। তার এই বইয়ে উঠে এসেছে কংগ্রেস, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলাপ, যার পুরোটাই তার স্বচক্ষে দেখা।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল
বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। গ্রন্থটির লেখক ছিলেন বাইশ বছর বয়সের একজন ফ্রেঞ্চ তরুণ, যিনি অসাধারণ দক্ষতায় বিশ্লেষণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশ জুড়ে সূচিত হয়েছিল ব্যাপক রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল একাধিক পরাশক্তির হাতে। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ভারত, সোভিয়েতের মতো শক্তিগুলো পক্ষে না থাকলেও পরবর্তীতে তারা সঙ্কটের সমাধানে এগিয়ে আসে, যাতে করে এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণহীন ও কট্টর কোনো যুদ্ধে পরিণত হতে না পারে। এই বইটিতে লেখক এই বাস্তবতাগুলো অনেকগুলো বিষয়কে উপজীব্য করে ব্যাখ্যা করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে হাজির করেছেন ব্যতিক্রমী কিন্তু জরুরি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ।
বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী
সুদীর্ঘ সময় ধরে উপমহাদেশের শাসনভার বহন করার পর কালের পরিক্রমায় মুসলিমরা নেমে আসে শাসক থেকে শাসিতের কাতারে। এরপর একের পর এক আসতে থাকে ইতিহাসের অন্যান্য পর্বগুলো—ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বিদ্রোহ, লড়াই। আজ এতোদিন পর যখন আমরা ইতিহাসের পাতা উল্টাই, তখন সবিস্ময়ে লক্ষ্য করি এই সুদীর্ঘ সময়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস আজকের ঐতিহাসিক বয়ানে গরহাজির। অথচ এ অঞ্চলের পরিচয় আর সমৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে আছে ইসলাম আর মুসলিমের নাম। তাই নিজেদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই ‘বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী’ বইটি লেখা, যেখানে বাঙ্গালী মুসলমানের একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বায় রূপ নেবার পর্বগুলো বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। আলোচিত হয়েছে আমাদের সমৃদ্ধ অতীত, যা স্রেফ কোনো রোমান্টিক কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লেখক এই বইটিতে তুলে ধরেছেন বাংলার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট কাঠামোগত বয়ান।
Leave a Reply