বছরের প্রতিটি দিনই আল্লাহর ইবাদাতের দিন। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু দিন আছে এমন, যখন ইবাদাতের মূল্য বেড়ে যায় অনেক। সেই দিনগুলোতে আল্লাহর আনুগত্য যেমন অধিক মূল্যবান, তেমনি আল্লাহর অবাধ্যতাও অধিক মন্দ। এমনই মূল্যবান ও অত্যন্ত সম্মানিত কিছু দিনের মধ্যে আছে মুহাররম মাস। হিজরি সনের প্রথম এই মাসটি “আশহুরে হুরুম” তথা সম্মানিত চার মাসের অন্যতম। এই মাসগুলো আল্লাহ আযযা ওয়া জাল ইরশাদ করেন –
“নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বারো মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন যুলুম করো না।” [সূরা আত-তাওবাহ : ৩৬]
হাদীসেও এই সম্মানিত মাসগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে। আবু বাকরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “বছর হলো বারোটি মাসের সমষ্টি, তার মধ্যে চারটি অতি সম্মানিত। তিনটি পর পর লাগোয়া জিলক্বদ, জিলহজ্ব ও মুহাররম আর (চতুর্থটি হলো) জুমাদাস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী রজব।” [সহীহ বুখারী : ২৯৫৮]
মুহাররম নামটি নামবাচক নয়, বরং গুণবাচক। এই মাসটি অতি সম্মানিত বা মুহাররম বলেই এর নামও হয়ে গেছে মুহাররম। এই মাসগুলোতে আল্লাহ যুলুমে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। এই মাসে সাওয়াবের কাজ ও গুনাহর কাজ দুটোই ওজনে ভারী।
বছরের বারোটি মাসের মধ্য থেকে আল্লাহ মুহাররম সহ চারটি মাসকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করে নিয়েছেন। এগুলোকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন অপর মাসগুলোর উপরে। আর তাই আল্লাহ যাকে সম্মানিত করেছেন, আমাদেরও উচিত তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা। এই মাসে বেশি বেশি নেক আমল করা, যথাসম্ভব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহকে স্মরণ করা বছরের অন্যান্য সময়ের থেকে বহুগুণে উত্তম। এমনকি জাহিলী যুগের লোকেরাও এই চারটি মাসে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকতো। এই অশেষ ফযিলতপূর্ণ মাসে আমাদেরও উচিত বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদাত ও যিকিরে নিমগ্ন থাকা।
এই মাসে বিশেষ করে অধিক পরিমাণে রোযা রাখতে হাদীসে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “রামাদ্বানের পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররম (মাসের রোযা)।” [সহীহ মুসলিম : ১৯৮২]
মুহাররমের মর্যাদা যে কতো বেশি এবং এই মাস যে কতো বেশি ফযিলতে ভরপুর, তার প্রমাণ মেলে এই হাদীসে। এই হাদীসে মুহাররমকে “শাহরুল্লাহ” বা “আল্লাহর মাস” বলে অভিহিত করে এই মাসের বিশেষ সম্মানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অথচ সবগুলো মাসই তো আল্লাহর। তবে মুহাররমকে আলাদা করে কেন আল্লাহর মাস বলা, কী এর রহস্য? রহস্যটি হলো, এই মাসের এমন বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার কারণে একে আলাদা করে আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করা হয়েছে।
মুহাররম আরো একটি দিক দিয়ে অনন্যতা লাভ করেছে আর তা হলো আশুরা। আশুরা হচ্ছে মুহাররমের দশ তারিখ। এই তারিখে রোযা রাখা মুস্তাহাব। রামাদ্বানের রোযা ফরয হবার আগে এই দিনের রোযা ফরয ছিল মুসলিমদের উপর। রামাদ্বান ব্যাপী রোযা ফরয হবার পর এই দিনের রোযা নফল হিসেবে নির্ধারিত হয়। কিন্তু সাধারণ নফল রোযার চেয়ে আশুরার দিনের রোযা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আবু কাতাদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আশুরার রোযা সম্পর্কে জানতে চাইলো। জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহর কাছে আমার আশা, তিনি এই রোযার মাধ্যমে বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।” [সহীহ মুসলিম : ১১৬২]
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এসে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোযা পালন করছে। নবীজী বললেন, এটি কী? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা আলাইহিস সালাম রোযা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হক্বদার। অতঃপর তিনি রোযা রেখেছেন এবং রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।” [সহীহ বুখারী : ১৮৬৫]
এক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা ছিল ইহুদিদের থেকে পার্থক্য বজায় রাখতে মুহাররমের নয় তারিখ আরো একটি রোযা রাখা। মোটকথা একটি রোযা বাড়িয়ে রাখা, আশুরার আগে অথবা পরে।
আশুরার দিন তাওবাহ কবুলের বিশেষ সম্ভাবনা থাকায় এদিন আমাদের বেশি বেশি তাওবাহ ও ইস্তিগফার করা দরকার। এদিন রোযা ও ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহ বিগত পুরো এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন! সুবহানাল্লাহ!
আসুন, আমরা মুহাররমের ইহতেরাম করি। বেশি করে নেক আমল করি ও গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে তাওবাহ-ইস্তিগফার করি। আশুরা ও তার আগে বা পরের দিন রোযা রাখি। এতো বরকতময় মাস ও দিন পুরো একটি বছরে খুব কমই আসে। আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
মাসভিত্তিক আমল সম্পর্কে কুরআন হাদীসের আরও বক্তব্য জানতে পড়ুন:
সময়কে কাজে লাগান
লেখক : ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রহঃ), শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান মুহান্না
বারো চান্দের ফজিলত
লেখক : শাইখ আব্দুল্লাহ মাহমুদ
নবীজির দিন-রাতের আমল
লেখক : ইমাম ইবনুস সুন্নী (রহ.)
কুরআন সুন্নাহর আলোকে বারো মাসের করণীয় বর্জনীয়
লেখক : মুফতি রেজাউল কারীম আবরার
Leave a Reply