বদনজর: যেভাবে জীবন নষ্ট করে দেয়

‘ওয়াও! কি কিউট বাচ্চাটা!
সেই ভাই, সেই! যা লাগতেসে না আপনাকে!
বাহ! আপনার পাখিটা তো বেশ সুন্দর!

উপরের বলা কথাগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনে বেশ পরিচিত কিছু কথা। সুন্দর কিছু দেখলে আমরা নিজেদের বিস্ময় প্রকাশ করি, সেটার প্রশংসায় লিপ্ত হই। কিন্তু এই বিস্ময় আর প্রশংসার মাঝে আমরা ভুলে যাই আল্লাহকে। আর আল্লাহর নাম ছাড়া এই বিস্ময় আর প্রশংসাবাণীগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকে খাতরা, ভয়ানক এক বিপদ যার নাম বদনজর।

বদনজর হলো এমন এক ধরনের বিষাক্ত চাহনি, যার ফলে কোনো ব্যক্তি অসুস্থতা ও শারিরীক ক্ষতির শিকার হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, নজরের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নাই, এর মধ্যে বিদ্যমান প্রভাব আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন।

বিজ্ঞানবাদের এই যুগে অনেকেই বদনজরকে স্রেফ ভুয়া বলে উড়িয়ে দিতে চান। মুসলিমদের মধ্যেই অনেকে আছেন যারা বদনজরকে বিশ্বাস করেন না। তথাকথিত বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে তারা একে অস্বীকার করতে চান। অথচ ইসলামের কাছে বিজ্ঞান স্রেফ শিশুমাত্র। আর সবচেয়ে বড় কথা, বদনজরে বিশ্বাস দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত এবং এ বিষয়ের সত্যায়ন এসেছে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে –

“বদনজর সত্য”। [সহীহ বুখারী, ১০/২১৩]

আরেকটি হাদীসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“নজর সত্য। কোনো জিনিস যদি তাকদীরকে পরাজিত করতে পারতো তবে অবশ্যই বদনজর একে পরাজিত করতো।” [মুসলিম : ২১৮৮]

বদনজরের কুপ্রভাব যে কতো মারাত্মক হতে পারে, সে সম্পর্কে জানতে নিচের হাদীসটিই যথেষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“বদনজর মানুষকে কবর পর্যন্ত এবং উটকে পাতিল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।” [সহীহ আল জামে : ১২৪৯]

বদনজর মানুষকে ঠিক কতখানি আক্রান্ত করতে পারে, তার জন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করা যাক। সত্য ঘটনা, নববী যুগের ঘটনা।

সাহল বিইন হুনাইফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। অত্যন্ত সুদর্শন একজন সাহাবী। একদিন তিনি গোসলের জন্য শরীর থেকে কাপড় খুলেছিলেন। সে সময় আমির বিন রাবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। সাহল রাদ্বিয়াল্লাহু ছিলেন সুঠামদেহী, সুশ্রী গড়নের যুবক। তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রশংসাসূচক কিছু কথা বলেন। এরপরই সাহল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এই খবর পৌঁছালে তিনি জানতে চাইলেন সাহাবীরা এই ব্যাপারে কারো নজর লাগার সন্দেহ করছেন কিনা। তাঁরা তখন আমির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা বললেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ধমকালেন এবং বললেন, “যদি কোনো জিনিস ভালো লাগে, তবে সে জিনিসের বরকতের দুআ করবে।” তারপর নজরের চিকিৎসা হিসেবে আমির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওযু করলেন এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ধুয়ে নিলেন। তাঁর সেই পানি একটি পাত্রে সংরক্ষণ করে সাহল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর গায়ে ঢেলে দেওয়া হলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।

প্রিয় পাঠক! ঘটনাটির দিকে খেয়াল করুন। উভয়েই সাহাবী এবং সাহাবীরা একে অন্যের ব্যাপারে হিংসা পোষণ করবেন কিংবা মন্দ চাইবেন, এটা কল্পনাতীত। আর এখানে তো বলাই আছে যে আমির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রশংসার সুরে কিছু কথা বলেছিলেন এবং সেই দৃষ্টিতেই তাকিয়েছিলেন। যেমনটা আমরা কোনো সুঠামদেহীকে দেখলে তাকাই এবং বলি যে বাহ, কি চমৎকার গঠন তার! তিনিও তেমনটাই কিছু বলেছিলেন। অতএব এখানে হিংসা বা নেতিবাচক কিছুই ছিল না। তার উপর তিনি ছিলেন বদরী সাহাবী। কিন্তু তবুও প্রশংসাসূচক বাক্যের সাথে আল্লাহর নাম যুক্ত না থাকায় তাঁর মতো মহান ব্যক্তির পক্ষ থেকেও নজর লাগার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেছে। এবং ফলাফলটাও ছিল গুরুতর। সাহল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মতো শক্তসমর্থ মানুষ, মাত্রই যাঁর দেহসৌষ্ঠবের প্রশংসা করেছেন আরেকজন সাহাবী, তিনি সাথে সাথে ধরাশায়ী হয়ে যান। রীতিমতো অসুস্থ হয়ে যান তিনি।

এরকম ঘটনা আশেপাশে অহরহ। জরুরি নয় সব ঘটনাই নজরের ফলে হয়। কিন্তু নজরের খারাপ প্রভাব সত্য এবং এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকাটা খুব জরুরি।

বদনজরের লক্ষণ

বদনজরের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখলে কেউ বদনজরের শিকার হয়েছেন কিনা সেটা বোঝা যায়।এখানে কিছু লক্ষণ আমরা উল্লেখ করছি –

  • সবকিছু কেমন যেন অবনতির দিকে যাওয়া।
  • ব্রণ, চর্মরোগ ইত্যাদির প্রকোপ বেড়ে যাওয়া।
  • হুট করে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া।
  • কাজে মনোযোগ না বসা।
  • শরীরে অস্থিরতা কাজ করা।
  • ঘন ঘন ভুল করা এবং ভুলে যাওয়া।
  • কাঁধ, মাথার উপরে বা পেছনে ভার হয়ে থাকা।

এরকম আরো কিছু লক্ষণ আছে, যা থেকে বদনজরের বিষয়টি আঁচ করা যেতে পারে।

বদনজর থেকে বেঁচে থাকবার উপায়

  1. যিকর বেশি বেশি করা।
  2. কোনো নিয়ামত দেখলে বা কারো কিছু ভালো দেখলে বা শুনলে “মা শা আল্লাহ, লা ক্বুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ” বলা।
  3. নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে জনে জনে বলেকয়ে না বেড়ানো।
  4. বদনজর থেকে বেঁচে থাকার জন্য মাসনুন দুআগুলো নিয়মিত পাঠ করা।
  5. প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করা।
  6. নিয়মিত সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করা।

বদনজরের বিষয়ে আমরা আজ থেকেই সতর্ক হই। আয়নায় নিজের চেহারা দেখা থেকে শুরু করে নিজের বা অন্যের যেকোনো কিছু বা যে কারো প্রশংসা করতে গেলে আমরা যেন অবশ্যই মা শা আল্লাহ বলি। আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশ করি। আল্লাহর গুণগান করি। আর সবসময় মাসনুন দুআ ও যিকরের সাথে লেগে থাকি। বদনজর থেকে নিজেকে, নিজের পরিবার ও আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকেই নিরাপদ রাখতে চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সকল অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখুন। আমীন।


by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *