কুরবানি নাকি গরীবদের টাকা দান: কী করব, কীভাবে করব? 

মুসলিমদের উৎসবের দিন দুটি। একটি তো রমাদানের পর ঈদুল ফিতর আর আরেকটি হলো হজ্জ্ব মৌসুমের ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহায়—আমাদের দেশে যা কুরবানি ঈদ বা বকরি ঈদ নামে পরিচিত—মুসলিমরা ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক আল্লাহর রাহে হালাল পশু কুরবানি করে থাকেন। ঈদুল আযহায় করা এই পশু কুরবানির বিধান কুরআনে পাওয়া যায় সূরা আল আনআম এর ১৬১-১৬৩ নং আয়াতে। সূরা আনআমে আল্লাহ তাআলা করেছেন: 

“আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথের দিকে, এক বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে। অর্থাৎ একনিষ্ঠ ইবরাহীমের মিল্লাত (তরীকা), আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার সালাত, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু—সমস্ত জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আর ওই বিষয়েই আমাকে আদেশ করা হয়েছে। সুতরাং আমি হলাম আত্মসমর্পণকারীদের প্রথম।” 

এছাড়াও সূরা আল কাউসারের ২ নং আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা কুরবানির আদেশ করেছেন। এটা হচ্ছে সেই কুরবানি যা জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে অর্থাৎ ঈদের দিনগুলোতে আমরা করে থাকি। 

এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসে ঈদের দিন কুরবানির বিধান বিস্তারিত পাওয়া যায়। 

আবু হুরায়রা (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করলো না (অর্থাৎ তার কুরবানী করার সংকল্প নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।’ (মুসনাদে আহমদ ২/৩২১)

আলী (রাদ্বি.) বলেন-

‘আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানী পশুর) চোখ ও কান ভাল করে দেখে নিই এবং কান-কাটা, কান-চেরা বা কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশু দ্বারা কুরবানী না করি।’ (মুসনাদে আহমদ ১/৮০)

অতএব, ঈদের দিন কুরবানি করা পুরোপুরি স্বতন্ত্র একটি ইবাদাত, যা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। 

বর্তমানে অনেকেই বলে থাকেন যে কুরবানি না করে অসহায়-গরীবদের কুরবানির অর্থ বিলিয়ে দেবার জন্য। বর্তমানে সিলেট সহ অনেক এলাকায় বন্যার দুর্গতদের জন্যও এরকম কিছু একটা করার রব উঠেছে। সচেতন ব্যক্তিবর্গ যদি একটু খেয়াল করে দেখেন, যারা এসব কথাবার্তা বলেন তারা আর কোনো ধরনের উৎসব, অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন না। শুধুমাত্র কুরবানির সময়ই তাদের এসব কথা শোনা যায়। আমরা যদি তাদের এসব কথা এড়িয়েও যাই, তবুও কেন আমরা কুরবানি করবো সেটার ব্যাপারে যথেষ্ট কথা বলা যায়। নিচে আমরা এই বিষয়ে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করছি আমাদের পাঠকদের সুবিধার্থে। 

১। কুরবানি ও দান-সাদাক্বাহ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ইবাদাত

কুরবানি ও দান-সাদাক্বাহ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ইবাদাত। একটি দিয়ে আরেকটি আদায় করা যায় না। কেউ যদি বলেন যে কুরবানি না করে তিনি এই অর্থ গরীব-দুঃখীদের দান করে দেবেন তবে এতে করে তার কুরবানি করার যে ইবাদাতটি সেটি কিন্তু আদায় হবে না।

২। কুরবানির আর্থ-সামাজিক প্রভাব ব্যাপক

কুরবানির আর্থ-সামাজিক প্রভাব ব্যাপক। এই একটি মৌসুমেই এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ আমিষ জাতীয় খাবারের বেশ ভালো একটা যোগান পান। কুরবানির জন্য দেওয়া আল্লাহর বিধান অনুসারে মুসলিমরা জবাইকৃত পশুর পুরো গোশতটুকু নিজের কাছে রেখে দেন না। বরং এর অধিকাংশই দরিদ্র মানুষ, আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে দেওয়া হয় এবং একটি নির্দিষ্ট অংশ নিজের কাছে রাখা হয়। ঈদের মৌসুমে গরুর মাংস অনেকেই সংরক্ষণ করেন এবং সেটা দিয়ে একটা লম্বা সময় তাদের পরিবারে গোশতের চাহিদা বেশ চমৎকারভাবেই মিটে যায়। 

৩। কুরবানি: গরীব-দুঃখীদের জন্যই

কেউ যদি প্রকৃত অর্থেই গরিব-দুঃখীদের জন্য কাজ করতে চান, তবে তিনি আসলে কুরবানিই করবেন। কারণ এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভালো ও পুষ্টিকর খাবারের যোগান দেবার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও তিনি রাখবেন বেশ ভালো একটি ভূমিকা। কুরবানির ঈদে পশু বেচাকেনার মাধ্যমে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ ও পশু মালিকরা আর্থিক দিক যেভাবে লাভবান হন, সেটা বছরের অন্যান্য সময় আসলে ঘটে না।

৪। যারা একাধিক পশু কুরবানি দেবেন

কেউ যদি একাধিক পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে তিনি পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি পশু দিয়ে অন্য পশুর অর্থ গরীবদের মাঝে বন্টন করে দিতে পারেন। এতে করে কুরবানি ও সাদাক্বাহ দুটোই একসাথে আদায় হলো।

৫। কুরবানি বছরে একবারই

কুরবানি বছরের এই একটা সময়েই আসে। এমন না যে মুসলিমরা সারা বছরই এভাবে ব্যাপকভাবে পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। বরং বাস্তবতা তো এই যে মুসলিমরা পুরো বছরজুড়েই দান-সাদাক্বাহ চালিয়ে যান। কুরবানির মৌসুমে বরং এর সাথে আরো যুক্ত হয় কুরবানির আনন্দ। নিম্ন আয়ের মানুষজন যেভাবে এই কুরবানিকে কেন্দ্র করে আর্থিকভাবে ও পুষ্টিগতভাবে লাভবান হন, তেমনি সমৃদ্ধ হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। শুধুমাত্র এই একটি মৌসুমকে কেন্দ্র করে চাঙা হয়ে ওঠে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। 

আমরা এখানে অল্প কিছু বিষয়ের উল্লেখ করলাম মাত্র। তবে এটুকু তো পরিষ্কার যে, কুরবানি আর গরীবদের দান—এই দুটি বিষয় না একটি অপরটির পরিপূরক আর না প্রতিবন্ধক। কেউ যদি কুরবানির অর্থ দান করে দিয়ে কুরবানির হক্ব আদায় করতে চান, তবে নিশ্চিতভাবেই সেটি হবে না। এই বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর অবস্থান পরিষ্কার।

উপরের পয়েন্টগুলোতে আমরা জাগতিক দিক থেকে কুরবানির পক্ষে বেশ কিছু অবস্থান তুলে ধরলেও কুরবানি মূলত আমরা করবো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। আল্লাহ বলেছেন, তাই আমরা করবো। এটাই একজন মুসলিমের অবস্থান। আর হ্যাঁ, যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা ঈদুল আযহায় পশু কুরবানি করবো, সেই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমরা অসহায় ও দরিদ্র ভাইবোনদেরকে মুক্ত হস্তে দান করবো। আমরা যদি চাই তবে দেশের বন্যা দুর্গত এলাকায় অসহায় ভাইবোনদের মাঝে কুরবানির গোশত বিলিবন্টন করতে পারি।

ইতিমধ্যেই অনেক সংস্থা এই মহৎ উদ্যোগটি গ্রহণ করেছেন। এতে করে ঈদের খুশিতে আমাদের অসহায় ও দুঃখী ভাইবোনদের আমরা শরীক করে নিতে পারবো। একইসাথে তাদের দুরবস্থা নিরসনে তাদেরকে অর্থসহায়তা দিয়েও এই বিপদের দিনে তাদের পাশে আমরা দাঁড়াবো। এই দুটি কাজ একইসাথে আমাদের দায়িত্ব এবং কখনোই এক দায়িত্বকে অপর দায়িত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় না।

আমরা আশা করছি, আমাদের এই সামান্য প্রচেষ্টা এই সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝির নিরসনে আপনাদের কাজে আসবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ সহজ করুন। আমীন।  

কুরবানির শিক্ষা, মাসআলা মাসাইল জানতে যে বইগুলো পড়তে পারেন:
https://www.wafilife.com/shop/books/ahkame-qurbani-by-ittihad
https://www.wafilife.com/shop/books/qurbani-o-akika
https://www.wafilife.com/shop/books/masayele-qurbani-o-akika-5/


by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *