ইতিহাসের দর্পণে প্রাচীন বাংলা: অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা

শুরুটা করা যাক একটা ধাঁধা দিয়ে।

এমন একটা দেশের নাম বলুন, যেখানে ঢোকার রাস্তা তো হাজারটা, কিন্তু বেরোনোর রাস্তা একটাও না।

বলুন তো, সে দেশ কোন দেশ?

আপনারা বসে বসে মাথা ঘামাতে থাকুন, ততক্ষণে আমরা অন্য গল্প করতে থাকি।

পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চলের যদি একটা তালিকা করা হয়, তবে সেখানে এই বঙ্গভূমির নাম উপরের দিকেই থাকবে। ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উর্বর এই ভূমির প্রতি তাই যুগ যুগ ধরেই লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে এসেছে রাজশক্তিগুলো। জলের মতো নদীপথের সাথে স্থলপথ যুক্ত হয়ে এই অঞ্চলে প্রবেশের পথ তো সৃষ্টি হয়েছে অগণন। কিন্তু এর সম্পদ আর প্রাচুর্যের মায়া রুদ্ধ করে দিয়েছে এই ভূমিকে ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার সব রাস্তাকে। পাঠক আশা করি, এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছেন উপরের ধাঁধায় কোন দেশটির কথা বলা হয়েছে।

বিস্তৃত এই অঞ্চলের ইতিহাসটাও এর প্রকৃতির মতোই বৈচিত্র্যে ভরপুর। অসংখ্যবার হয়েছে এর শাসনক্ষমতার পালাবদল, ক্ষমতার মসনদে কেউ হয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী তো আবার কেউ কেউ সেখানে বসেছেন অল্প কিছুদিনের জন্য। ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলা কখনোই এককভাবে একটি রাজনৈতিক সত্তা হয়ে উঠতে পারেনি, যদিও এর জনগণের সামাজিক, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সাদৃশ্যই ছিল বেশি।

বাংলার এই বৈচিত্র্যময় ইতিহাসকে জানাটা তাই বেশ চ্যালেঞ্জিং। একক রাজনৈতিক সত্তা না থাকায় অসংখ্য ছোট-বড় রাজ্যে বিভক্ত ছিল বাংলা। তাই এই সবগুলো রাজ্যের সম্মিলিত ইতিহাসই হচ্ছে বাংলার ইতিহাস। এই ইতিহাসের ব্যাপারে আমাদের জানাশোনাটা নিতান্তই কম। অথচ গুরুত্বের বিচারে নিজ ভূমির ইতিহাসই সর্বাধিক গুরুত্বের তালিকায় থাকে। ইতিহাসের এই পাঠের সাথে জড়িত থাকে জাতিগত পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

একেকটি জাতিসত্তা তাদের মৌলিকত্বের দিক থেকে স্বতন্ত্র। সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষার বিচারে প্রাচীন বাংলার ছিল নিজস্বতা। সেই অবস্থানকে যদি কেউ বুঝতে না পারেন, তবে আজকের দিনেও অনেক কিছুই তার বুঝতে কষ্ট হয়ে যাবে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বলে একটা কথা আছে। ধরুন, আজকে এদেশে বাঙালি সংস্কৃতি শিরোনামে যা যা চালু আছে, তার গোড়া কোথায়? কিংবা জাতি হিসেবে আমাদের যে বিশিষ্টতা বা স্বাতন্ত্র্য, তার উৎসমূল কোথায়? এরকম নানা প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আপনাকে ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়তেই হবে।

আরেকটি জরুরি প্রসঙ্গ এখানে বাকি রয়ে যায় আর সেটা হচ্ছে আত্মপরিচয়। সৃষ্টিগতভাবে একেকটি জাতিসত্তা একেক রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নিজের এই শেকড়কে না জানা, নিজের পরিচয় আর গোড়া সম্পর্কে বিস্মৃত থাকা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ব্যর্থতার পরিচায়ক। আমরা একটু আগেই বলে এসেছি বাংলার ইতিহাস নিয়ে যদি কেউ ধারণা না রাখেন, বাংলার শাসনতান্ত্রিক সিলসিলা সম্পর্কে যদি তিনি অজ্ঞ থাকেন; তবে বর্তমানের রাজনীতি, সমাজ কাঠামো ও মানুষের আচরণগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও তিনি অজ্ঞই থেকে যাবেন। উপমহাদেশীয় রাজনীতি ও সমাজ কাঠামোর যে উত্তরাধিকার আজও বয়ে চলেছি আমরা, সেটার ব্যাপারে সম্যক ধারণা লাভ কখনোই প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পাঠ ছাড়া সম্ভব হতে পারে না। আজকে পাক-ভারত-বাংলা যে রাজনৈতিক আবর্তের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তার নাড়ি ধরতে হলে ইতিহাসের দ্বারস্থ না হওয়া পর্যন্ত আপনি বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না। আর এই বিষয়ে আপনার পাঠের সূচনাতেই থাকবে প্রাচীন বঙ্গভূমির ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস।

বাংলাকে জানবেন না, বাংলার নাড়িও ধরতে পারবেন না। আর পরিবর্তনের পিয়াসী কোনো ব্যক্তি তার ভূমির নাড়িকে স্পর্শ না করেই পরিবর্তনের সূচনা করে ফেলবেন, সে আশা দুরাশা মাত্র!

প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের পাঠ নিতে পড়তে পারেন নিচের বইগুলো:

১। এ শর্ট হিস্ট্রি অব মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া

২। বাংলার ইতিহাস

৩। বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস

৪। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *