বিপদ যখন নিয়ে আসে নিয়ামতের সুবাস

ক্লান্ত এক নওজোয়ান, বসে আছেন গাছতলায়। তাঁর সুঠাম দেহ জুড়ে ক্লান্তিরা সব ভর করেছে। দীর্ঘ পথচলা আর এই পুরোটা সময় ধরে ধরা পড়ে যাবার ভয় তাঁর শরীর আর মন দুটোরই সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে কিছুটা নিরাপদ বোধ হলে থামলেন যুবক, পরিশ্রান্ত দেহকে এলিয়ে দিলেন সবুজ পাতার সুশীতল ছায়াতলে। বিধ্বস্ত দেহ-মন নিয়ে হাত তুললেন মালিকের দরবারে, আবেদন জানালেন অনুগ্রহের জন্য; বড় মর্মস্পর্শী তাঁর সে আবেদন! মহামহিম আল্লাহর দরবারে অন্তরের আকুলতা আর অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটলো তাঁর এই শব্দমালা দিয়ে – 

“রাব্বি! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহই নাযিল করবেন, আমি তো তারই মুখাপেক্ষী!” 

এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক। যুবকটি ছিলেন প্রতাপশালী ফিরাউনের ঘরে লালিত-পালিত আদরের দুলাল। আপন সন্তান না হয়েও তাকে ফিরাউন ও ফিরাউন-পত্নী আসিয়া আলাইহাস সালাম এর ঘরে তিনি লালিত হয়েছিলেন পরম যত্নে। সম্প্রতি এক কিবতীর সাথে বিবাদের সূত্র ধরে তাকে এক ঘুষি বসিয়ে দিলে কিবতী লোকটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। অথচ আঘাতটি তেমন গুরুতর ছিল না। কিন্তু ঘটনা যা ঘটবার তো ঘটেই গেছে। যুবকটির উপর জারি হয় ওয়ারেন্ট, তাঁকে ধরতে হন্যে হয়ে পেছনে লাগে ফিরাউনের লোকজন। জীবন বাঁচাতে এক কাপড়ে যুবককে ত্যাগ করতে হয় ঘরবাড়ি, মাতৃভূমি। এই চরম বিপদে তিনি যখন ছুটে চলছিলেন নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে, তখনও কি তিনি জানতেন যে এই বিপদই তাঁর জন্য বয়ে নিয়ে আসছে এক নতুন জীবনের সওগাত? 

গাছতলায় ফিরে আসা যাক। যুবকের আকুল আবেদনে সাড়া দিলেন স্নেহশীল মালিক। অদূরে এক কূপের কাছে রাখালদের ভিড়, পানি তুলে পশুপালকে পান করাবে সবাই। সেই ভিড়বাট্টা থেকে কিছুটা দূরে অসহায় দাঁড়িয়ে আছে দুটি মেয়ে, তাঁদেরও দরকার ছিল পানি ওঠানোর। যুবক দেখলেন, উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ভিড় ঠেলে তাঁর সুঠাম, শক্ত-সমর্থ হাতে তুলে আনলেন বালতি ভরা পানি। মেয়েদের প্রয়োজন মিটলো, তাঁরা চলে গেলেন। যুবক ফের হেলান দিলেন গাছের তলে। কিছুক্ষণ পর সেই দুই মেয়ের মধ্য থেকে একজনের লাজুক আগমন, তাঁর সাথে যুবকের সেই মেয়েটির বাড়ি গমন, সেখানে মেয়েদের বাবার সাথে সাক্ষাৎ, রাখালি করার প্রস্তাব প্রাপ্তি ও গ্রহণ এবং নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর বড় মেয়ের সাথে বিয়ে এবং তারপর…. 

আমাদের সচেতন পাঠক হয়তো বহু আগেই বুঝে গিয়েছেন এতোক্ষণ আমরা কার গল্প বলে গেলাম। একজন মুসা, নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থায়, মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা মাথায় নিয়ে যখন জীবন হাতে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কি তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে কুদরতে ইলাহী তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ ও মর্যাদার এক জীবনের দিকে? তিনি ছিলেন নিঃস্ব, আল্লাহ তাঁকে বানিয়ে দিলেন সম্পদের মালিক। তিনি ছিলেন একাকী, আল্লাহ তাঁকে দিলেন প্রেমময়ী জীবনসঙ্গীনী। ছিলেন আশ্রয়হারা, নিরাপত্তাহীন; আল্লাহ তাঁকে ব্যবস্থা করে দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের, যেখানে তিনি কাটিয়ে দিলেন দশ দশটি বছর। পালিয়ে এসে যখন গাছতলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন কিছুই ছিল না তাঁর। কিন্তু দশ বছর পর যখন মাতৃভূমির পথ ধরলেন, তখন আর কিছুর অভাব ছিল না তাঁর। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ ওই পর্যন্তই থেমে থাকেনি, বরং পবিত্র উপত্যকায় মহান আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করলেন রিসালাত ও নুবুওয়াতের বিরাট মর্যাদায়। পেলেন আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলার মতো বিরল এক সম্মান, সাধারণ একজন ব্যক্তি থেকে হয়ে উঠলেন আল্লাহর একজন রাসূল, মুসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম। 

প্রিয় পাঠক! একবার ভেবে দেখুন মুসা আলাইহিস সালামের কথা। কঠিনতম বিপদে পতিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বিপদটিই ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সব নিয়ামত প্রাপ্তির উসীলা। তাই এখন থেকে যখনই কোনো বিপদে পড়বেন, মুসা আলাইহিস সালাম এর কথা স্মরণ করবেন। তিনি যেভাবে আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে আল্লাহর অনুগ্রহ ভিক্ষা করেছিলেন, আপনিও সেভাবেই আপনার রবের দরবারে আপনার আরজি পেশ করবেন। দেখবেন, কীভাবে আল্লাহ সেই বিপদকে আপনার জীবনে নিয়ামতের সুবাস বয়ে নিয়ে আসার উসীলা বানিয়ে দেন। অতএব, বিপদ এলেই ভেঙে পড়বেন না, হতাশ হবেন না, বরং আল্লাহমুখী হোন। যত বড় বিপদই হোক না কেন, আল্লাহ সেটাকে নিয়ামতে পাল্টে দিতে সক্ষম। আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রাখুন, কারণ আল্লাহ নিজেই বলেছেন, আমি সেরূপই, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি পরম স্নেহশীল ও দয়ালু।

বিপদের সময়ে অনুপ্রেরণা পেতে যে বইগুলো আপনাকে সহায়তা করবে:

বিপদ যখন নিয়ামাত (২)
লেখক : ড. ইয়াদ কুনাইবী

দুশ্চিন্তাকে দিই ছুট্টি
লেখক : মুহাম্মাদ ইফাত মান্নান

দুঃখ-কষ্টের হিকমত
লেখক : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ, ইমান ইযযুদ্দিন আবদুস সালাম

হতাশা শব্দটি আপনার জন্য নয়
লেখক : শাইখ ড. মাশআল আব্দুল আযিয আল-ফাল্লাহি

রিল্যাক্স অ্যান্ড হ্যাপি
লেখক : শাইখ মুহাম্মাদ আল গাজালী


by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *