ভালোবাসা—মানুষের আদিমতম অনুভূতি। মানুষ ভালোবাসে। ভালোবাসে মানুষকে, প্রাণীকে, লতাগুল্মকে। ভালোবাসে তার কাজ, তার পরিবেশ, তার পরিবার-পরিজনকে। কখনো ভালোবাসে দূরের কাউকে, যাকে হয়তো দেখেওনি সে কখনো। ভালোবাসার মানুষের জন্য সে সবকিছু করে, করতে চায়; সবকিছুতে তার মতোই হয়ে যেতে চায়। যেন নিজের অস্তিত্বের সাথেই মিশিয়ে ফেলতে চায় সে তার ভালোবাসাকে!
ভালোবাসার এই হরেক রকম গল্পের মাঝে এমন একটি ভালোবাসা আছে, যার কোনো নজির নেই। না আগে ছিল, না আজ আছে আর না ভবিষ্যতে থাকবে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি ভালোবাসার যে ঢেউয়ের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর আগে, সেই ঢেউ আজও ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আজও মানুষ আকুল হয়ে তাঁর জন্য কাঁদে, তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করে, তাঁর জন্য জীবন দেয় ও নেয়। তিনি সেই ব্যক্তি যাঁকে ভালোবাসা নিছক আবেগ নিঃসৃত কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁকে ভালোবাসা একজন মানুষের মুসলিম পরিচয়ের জন্যই আবশ্যিক। যে রাসূলুল্লাহ ﷺ -কে ভালোবাসতে পারেনি, সে মুসলিম হতে পারেনি। রাসূল ﷺ -কে যে নিজের জীবন, নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান ও সম্পদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে পারেনি, সে নিজের ঈমানকে পূর্ণ করতে পারেনি। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, তাঁর অবস্থান এমন এক উচ্চতায়, যে তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ ভালোবাসা থাকার সাথে ঈমান পূর্ণ করার মতো গুরুতর বিষয়টি সরাসরি জড়িত! সুব’হানাল্লাহ!
আসুন, একটি ঘটনা জেনে নেওয়া যাক। মদীনাতুন নববী। নবীর শহর। একদিন আল্লাহর রাসূল ﷺ তাঁর প্রিয় সাহাবী উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে বসে আছেন। উমর ছিলেন খুব সোজাসাপ্টা মানুষ। যা মনের মধ্যে থাকতো, ঠিক সেটাই বলতেন। তিনি নবীজিকে বললেন, নিজের জীবন বাদে বাকি সবকিছু থেকে তিনি নবীকে বেশি ভালোবাসেন। তাঁর এই কথা শুনে রাসূল ﷺ জানিয়ে দিলেন যে, হে উমর! যতক্ষণ না তুমি আমাকে তোমার নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না।
এটা শুনে উমর নিশ্চুপ হয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন তিনি আল্লাহর নবীকে তাঁর নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসেন। এটা শুনে রাসূল ﷺ মন্তব্য করলেন যে হ্যাঁ, এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হয়েছে।
এমনই মাহাত্ম্য রাসূলকে ভালোবাসার। তাঁকে ভালোবাসা, তাঁর আনুগত্য করা হচ্ছে মুসলিম পরিচয়ের জন্য অপরিহার্য। শুনুন আল্লাহ কুরআনে কি বলছেন –
“বলুন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’।”
[সূরা আলে ইমরান ০৩:৩১]
আল্লাহ আরো বলছেন,
“(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যেকোনো কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।”
[সূরা তাওবা ৯:১২৮]
এমন একজন মানুষকে আপনি ভালোবাসবেন না? কীভাবে তাঁকে না ভালোবেসে আপনি ঈমানদার হবার আশা করতে পারেন?
আসুন, স্বয়ং রাসূল ﷺ এর ভাষ্যেই শুনি তাঁকে ভালোবাসার অপরিহার্যতার কথা।
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে প্রিয় হবো।”
[সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫]
রাসূল ﷺ -কে ভালোবাসা, তাঁর সম্মান রক্ষা করা, তাঁর আনুগত্য করা আমাদের জীবনের সবচেয়ে জরুরি কাজ। কারণ তাঁর আনুগত্যই আল্লাহর আনুগত্য, আল্লাহর আনুগত্যই ইসলাম আর ইসলামেই শান্তি ও মুক্তি। তাই একজন ঈমানদার হিসেবে এটা আমাদের ঈমানের দাবি যে আমরা আমাদের সবকিছু দিয়ে রাসূল ﷺ -কে ভালোবাসবো, তাঁকে সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসবো। যতক্ষণ এমনটা আমরা করতে পারছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের দাবিতে আমরা পরিপূর্ণ সৎ হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারবো না। আল্লাহ যেন রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার ও তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবার তাওফিক আমাদের দান করেন। আমীন।
নবীজি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে আসুন তাঁর সীরাত পড়ি। সীরাত বিষয়ক চমৎকার কিছু বই পাবেন এখানে: সীরাতে রাসূল (সা.)
Leave a Reply